পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও সন্ত্রাস নৈমিত্তিক ঘটনা প্রায়। দেশটিতে মুসলমান জনসংখ্যা ৯৭ শতাংশ এবং হিন্দুর সংখ্যা মাত্র ২ ভাগ। ফলে বিভিন্ন ছুতোতে সংখ্যালঘুদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন, ভাঙ্গা হয় তাদের প্রার্থনালয়। গত বুধবার(৩০ডিসেম্বর) পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এক গ্রামে তেমনি এক ঘটনা ঘটে। হিন্দুদের একটি মন্দিরে কয়েকশত মুসলমান হামলা ভাংচুর চালিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকা পেশোয়ার থেকে ১৬০ কিলোমিটারের দূরের একটি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এই পর্যন্ত ২৬ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, স্থানীয় মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের উসকানিতে সর্বোচ্চ ১২০০ মানুষ হিন্দু মন্দিরটি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। মুসলিম নেতাদের নির্দেশেরপর একদল মুসলমান হঠাৎ করে মন্দিরটির দিকে এগিয়ে গিয়ে হামলা চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে তারা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে এই ধ্বংসকার্য চালিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আর একটি সূত্রে অভিযোগ, কয়েক সপ্তাহ আগে ইমরান খানের সরকার সংখ্যালঘু পাকিস্তানি হিন্দুদের উদ্দেশে জানায়, পুরনো মন্দিরের সংস্কার বা নির্মাণে কোনও বাধা নেই। সরকারের সেই ছাড়পত্র পেয়েই হিন্দুরা এলাকার পুরনো এই মন্দিরটির সংস্কারে উত্সাহিত হয়েছিলেন। উগ্র মৌলবাদীদের তা সহ্য হয়নি। তাই তাদের উস্কানিতে কয়েক’শো ধর্মীয় উন্মাদ মন্দিরে চড়াও হয়। মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া এলাকায় টেরি গ্রামের একটি হিন্দু মন্দিরে আচমকা হামলা চালায় একদল মৌলবাদী। তারপর মন্দিরটি পুরো ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। মন্দিরের ভিতরে থাকা বিভিন্ন দেবতার মূর্তি রাস্তার উপর ফেলে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। চোখের সামনে সমস্ত কিছু দেখেও ওই এলাকার হিন্দুরা ভয়ে কোনও কথা বলতে পারেননি। তবে ঘটনার ভিডিও এবং ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর পাকিস্তানের হিন্দু নাগরিকদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনায় ২৬ জনকে এখনও অবধি গ্রেপ্তার করেছে পাক প্রশাসন। বাকিদের খোঁজে চলছে তল্লাশি।
পেশোয়ার থেকে ১৬০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত কারাক জেলায় ১৯ শতকের শুরুতে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে সেটি একবার ভাঙচুর করা হয়। পরে ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট এটি পুনর্নিমাণের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানের প্রায় ৮০ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় চারটি ধর্মীয় স্থানের মধ্যে এই মন্দির একটি বলে জানিয়েছেন পাকিস্তান হিন্দু কাউন্সিলের প্রধান ও সরকারি দলের সাংসদ রমেশ কুমার ভাঙকওয়ানি।
এদিকে মন্দিরে আগুন লাগানোর ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তানের মানবাধিকার কর্মীরা। এমনকি পাক মানবাধিকার মন্ত্রী শিরীন মাজারিও ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। এছাড়া অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তারে সংশ্লিষ্ট পুলিশ-প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।
আজ বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের ধর্মীয় বিষয়ক মন্ত্রী নুরুল হক কাদেরি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন। টুইট করে জানান, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থানে আঘাত করার কথা ইসলাম কোনওদিন শেখায়নি। পাকিস্তানের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য কিছু দুষ্কৃতী এই কাজ করেছে। তাদের কড়া শাস্তি দেওয়া হবে।
গত মাসেও করাচির লেহেরি এলাকার সালার কম্পাউডে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ছেলের নামে ইসলাম অবমাননার মিথ্যে অপবাদ দিয়ে হিন্দু মন্দির ভাঙচুর করা হয়। বিষয়টি জানা সত্ত্বেও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য পাকিস্তান দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন মানবধিকারকর্মীরা। কোনো ছুতো পেলেই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলে পড়ে। এছাড়াও হামলে পড়ার জন্য বিভিন্ন ছুতো তৈরী করার ক্ষেত্রেও পাকিস্তান মৌলবাদীরা তৎপর থাকে বলে জানান তারা। তারা জানান, পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হওয়ার কারণে তাদের ওপর নানাভাবে বৈষম্য করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতেই। সুন্নি মুসলিম-গরিষ্ঠ পাকিস্তানি সমাজ এই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হিংসা, গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ কিংবা জোর করে নির্বিচারে ইসলামে ধর্মান্তর করে চলেছে বলেও মন্তব্য করেন আন্তর্জাতীক মানধিকারকমীরা। পাকিস্তানে এই সব ঘটনায় প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, এমন কি এফআইআর নিতেও অস্বীকার করে বলে অভিযোগ করেন তারা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ