
বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৯ হাজার ১০০টি—যা শুধু একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক চিত্র নয়, বরং একটি সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের নির্মম দলিল। পুলিশ সদর দপ্তরের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতি মাসেই হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। মে মাসে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৮৭টি মামলা দায়ের হয়েছে, যা আগের মাসগুলোর তুলনায় ক্রমবর্ধমান হারের ইঙ্গিত দেয়। শুধু ঢাকা মহানগরীতেই (ডিএমপি) এ সময়কালে ৮০৫টি মামলা হয়েছে। এই চিত্রটি বিগত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা ভয়াবহ বাস্তবতা দেখতে পাই—২০২৪ সালের প্রথম পাঁচ মাসে মামলা ছিল ৭ হাজার ৩১৩টি, অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি মামলা বেড়েছে।
এই ক্রমবর্ধমান হারের পেছনে রয়েছে একাধিক সামাজিক ও কাঠামোগত ব্যর্থতা। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, যখন কোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন সেখানে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয় সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ—নারী ও শিশুরা। এই পরিস্থিতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে বিচার ব্যবস্থার ধীর গতি। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ১৮০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালকে মামলা নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ মামলাই বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে। এমনকি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না হলে সুপ্রিম কোর্টে কারণ ব্যাখ্যা করতে বাধ্য থাকলেও, সেটি কতখানি কার্যকরভাবে করা হয়—সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশেষজ্ঞ আসিফ নজরুল ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এই আইনি কাঠামোয় পরিবর্তন এনে ধর্ষণের মতো মামলার তদন্ত সময় ১৫ দিনে এবং বিচার ৯০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব প্রস্তাব এখনও নীতিগত বাস্তবতায় রূপ নেয়নি।
এদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা আরও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA)-এর প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে শারীরিক, মানসিক অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী সংস্থা এমএসএফ জানিয়েছে, প্রতিদিন গড়ে ১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে—যা নিয়মিত একটি সামাজিক মহামারীতে রূপ নিচ্ছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের অনেক সময় সামাজিকভাবে প্রভাবশালী বলে মনে করা হয়, ফলে ভুক্তভোগীদের বিচারপ্রাপ্তির পথ আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক সময়ের একটি ঘটনা বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে—২৬ জুন কুমিল্লার মুরাদনগরের পাঁচকিত্তা গ্রামে প্রবাসীর স্ত্রীর ওপর সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনা। অভিযুক্ত ফজর আলীকে স্থানীয় জনগণ ধরে ফেলে, তাকে মারধর করা হয়, এবং তারপরে তিনি পালিয়ে যান। অথচ এ ঘটনাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে হীন কাজটি করা হয়েছে, সেটিও ভয়াবহ। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কিছু লোক ভুক্তভোগীর ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়—যা একদিকে যেমন ডিজিটাল অপরাধ, অন্যদিকে ভুক্তভোগীর জন্য নতুন এক মানসিক নির্যাতন। পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপে মূল অভিযুক্তসহ ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ায় জড়িত আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই বিচ্ছিন্ন ঘটনা কি গোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন আনবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাও নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই পরিস্থিতিতে প্রান্তিক নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হন, কারণ অনেক পুরুষ মনে করে এই নারীদের জন্য কেউ লড়বে না বা তারা বিচার চাইতেও পারবে না। সমাজে নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা এবং পুরুষকে প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার মানসিকতা নারীর প্রতি সহিংসতাকে উৎসাহিত করে।
ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, রাষ্ট্রের উচিত প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে কঠোরভাবে দমন করে দ্রুত সময়ে বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে এই সহিংসতা কখনোই বন্ধ হবে না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং আইনি সংস্কারই পারে সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার সংখ্যা ১৮ হাজার থেকে ২২ হাজারের ঘরে ঘোরাফেরা করছে, যা প্রমাণ করে যে সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর। শুধুমাত্র আইন করে বা নতুন আইন প্রণয়ন করে এর সমাধান হবে না, বরং দরকার সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষার প্রসার, নারীর প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা এবং প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল ও সহানুভূতিশীল করে তোলা।
এই ভয়াবহ বাস্তবতায় সমাজ, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি—সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে আমাদের মাথায় রাখতে হবে, এককথায় এটি কেবল একটি অপরাধ নয়, বরং একটি জাতির বিবেকের পরীক্ষা। পরীক্ষায় বারবার ব্যর্থ হলে জাতির ভবিষ্যৎ কখনোই উজ্জ্বল হতে পারে না। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য দরকার আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা। তবেই আমরা বলতে পারব—বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে নারী-শিশুর জন্য নিরাপদ একটি রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে।
আপনার মতামত জানানঃ