বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এখন এক ভয়াবহ ও স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায় মৃত্যু ও আহত হওয়ার খবর। যাত্রী কল্যাণ সমিতির সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, শুধু ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে এক মাসেই দেশে ৫০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০২ জন নিহত ও ৯৬৪ জন আহত হয়েছেন। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে ১৭ জন মানুষ সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন। এ সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, এর পেছনে আছে শত শত পরিবারের অশেষ কান্না, অসহায়ত্ব ও জীবনের স্থায়ী ক্ষতি।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। মোট ১৯১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৯৯ জন নিহত এবং ১৮৮ জন আহত হয়েছেন। মোট দুর্ঘটনার প্রায় ২৯ শতাংশের সঙ্গে মোটরসাইকেল জড়িত। অর্থাৎ, প্রতিদিনের দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলই এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে, কিন্তু চালকদের প্রশিক্ষণ ও ট্রাফিক নিয়ম মানার প্রবণতা এখনো যথেষ্ট নয়। ফলে তরুণ বয়সের বহু প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে রাস্তায়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে—১২৬টি ঘটনায় ১২২ জন নিহত ও ২১৬ জন আহত হয়েছেন। এটি দেখায় যে, রাজধানী ও এর আশপাশের মহাসড়কগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকার যানজট, সড়কের অতিরিক্ত চাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত পারাপার এই পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করছে। অন্যদিকে, বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে—২২টি ঘটনায় ২৭ জন নিহত ও ৪৭ জন আহত হয়েছেন।
এ ছাড়া দুর্ঘটনায় জড়িত মোট ৭৭২টি যানবাহনের মধ্যে ২২ শতাংশ ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ডভ্যান, ১৬ শতাংশ বাস, ১২ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৭ শতাংশ সিএনজি অটোরিকশা, এবং প্রায় ৬ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি, জিপ ও মাইক্রোবাস। এই তথ্যগুলো স্পষ্ট করে যে, বড় যানবাহনের পাশাপাশি ছোট পরিবহনগুলোরও দুর্ঘটনা ঘটানোর প্রবণতা বাড়ছে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৪৮ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে গাড়ির চাপায়, অর্থাৎ পথচারী বা ছোট যানবাহন বড় গাড়ির ধাক্কায় মারা যাচ্ছে। ২৮ শতাংশ দুর্ঘটনা মুখোমুখি সংঘর্ষে, ১৮ শতাংশ ঘটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, আর প্রায় ৪ শতাংশ বিভিন্ন অন্য কারণে। এছাড়া চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে মৃত্যু, ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ বা রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনাও ঘটছে।
ভৌগোলিকভাবে দেখা যায়, ৪৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে জাতীয় মহাসড়কে, ২৪ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে এবং ২৫ শতাংশ স্থানীয় বা ফিডার রোডে। শুধু তাই নয়, ঢাকায় মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৪ শতাংশ ঘটে মহানগরের ভেতরেই, যা দেখায় নগরীর ভেতরেও সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নাজুক।
সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, এই দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে বহু কারণ কাজ করছে—অবহেলা, আইন না মানা, অতিরিক্ত গতি, ওভারটেকিং, ক্লান্ত চালক, সড়কের বেহাল অবস্থা, অপ্রশিক্ষিত ড্রাইভার, অবৈধ যানবাহন এবং যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অভাব। বাংলাদেশে এখন প্রায় ৪০ লাখ মোটরসাইকেল চলাচল করছে, কিন্তু চালকের লাইসেন্স রয়েছে তার অর্ধেকেরও কমের। অনেকেই হেলমেট ব্যবহার করেন না, আবার হাইওয়েতে তারা ৮০–৯০ কিলোমিটার গতিতে চলে যান। এক মুহূর্তের অসাবধানতাই তখন জীবন কেড়ে নেয়।
অন্যদিকে, মালবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও বাসের চালকরা অতিরিক্ত সময় কাজ করেন। তারা পর্যাপ্ত বিশ্রাম পান না, ফলে ক্লান্ত অবস্থায় গাড়ি চালান। ঘুমের ঘোরে বা তাড়াহুড়ায় নিয়ন্ত্রণ হারানো দুর্ঘটনার বড় কারণ। বিশেষ করে রাতের বেলায় হাইওয়েতে এই ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।
ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের বিষয়টিও এখন আলোচনায় এসেছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি সতর্ক করেছে যে, সরকারের পরিকল্পনায় ত্রুটি থাকলে অটো রিকশা নিবন্ধন কার্যক্রম দেশে সড়ক দুর্ঘটনা দ্বিগুণ করতে পারে। এই যানগুলো গ্রামীণ সড়ক থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু চালকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই, যানগুলো নিরাপত্তা মানদণ্ড মেনে তৈরি হয় না, এবং এগুলো হাইওয়েতে প্রবেশ করায় বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।
প্রশ্ন উঠেছে, এত মৃত্যুর পরও কেন সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না? বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা এখনো উন্নত নয়। পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগে জনবল কম, রাস্তার পাশে জরুরি সেবা নেই, এবং দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত উদ্ধার ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। অনেক সময় আহতরা সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারায় মারা যান। আবার, সড়কে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য ও দুর্নীতি পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে।
দুর্ঘটনা রোধে সবার আগে দরকার সচেতনতা। চালক, যাত্রী ও পথচারী—সবাইকে বুঝতে হবে, সড়ক নিরাপত্তা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি সবার দায়িত্ব। প্রতিটি চালককে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে এবং বৈধ লাইসেন্স ছাড়া কাউকে গাড়ি চালাতে দেওয়া যাবে না।
দ্বিতীয়ত, সড়কের নকশা ও মান উন্নত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের অনেক সড়কে ওভারটেকিং লেন, রোড ডিভাইডার বা সঠিক সাইনবোর্ড নেই। এতে ছোট ভুলই বড় দুর্ঘটনায় পরিণত হয়। বিশেষ করে মহাসড়কে দুই দিকের যানবাহন একই পথে চলায় সংঘর্ষের ঝুঁকি থাকে। উন্নত দেশে যেমন আলাদা লেন, রেলিং, ও সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ থাকে—বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
তৃতীয়ত, যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা নিয়মিত করতে হবে। অনেক বাস, ট্রাক ও মাইক্রোবাস বছরের পর বছর পুরোনো হয়ে গেলেও নিয়মিত পরীক্ষা ছাড়া রাস্তায় চলছে। অনেক যানবাহনে ব্রেক বা স্টিয়ারিংয়ের সমস্যা থাকে, যা হঠাৎ বিপদ ডেকে আনে।
চতুর্থত, চালকের বিশ্রাম ও সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। অনেক ট্রাকচালক ১৪–১৬ ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালান, যা বিপজ্জনক। তাদের জন্য নির্দিষ্ট বিশ্রামস্থল ও সময় নির্ধারণ করা জরুরি।
পঞ্চমত, পথচারী ও সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়াতে স্কুল, কলেজ ও গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচারণা চালাতে হবে। রাস্তায় মোবাইল ব্যবহার, হঠাৎ রাস্তা পার হওয়া, কিংবা ট্রাফিক সিগন্যাল উপেক্ষা করা—এসব অভ্যাস বদলানো জরুরি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, দুর্ঘটনার পর দ্রুত চিকিৎসা ও উদ্ধার ব্যবস্থা। অনেক দেশে দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে “ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম” ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশেও হাইওয়েতে এই ধরনের ব্যবস্থা চালু করা গেলে অনেক প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে।
সবশেষে, সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। আইন প্রয়োগ, সড়ক নির্মাণ, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা—সবকিছুই একসাথে করতে হবে। শুধু পুলিশ বাড়িয়ে বা জরিমানা দিয়ে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, কিন্তু আমাদের বিবেক কি জাগছে? একটি দুর্ঘটনায় শুধু একজনের জীবন যায় না—একটি পরিবার ভেঙে যায়, স্বপ্ন নষ্ট হয়, সন্তানরা অনাথ হয়। তাই এখনই সময় পদক্ষেপ নেওয়ার। সচেতন চালক, সুশৃঙ্খল সড়ক ও কঠোর আইন প্রয়োগ—এই তিনটি বিষয় একসাথে বাস্তবায়িত হলে হয়তো আর কোনো মা ছেলের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে হবে না।
বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে, কিন্তু এই উন্নয়নের রাস্তায় যেন মৃত্যু নয়, নিরাপত্তাই হয় মূল সঙ্গী—এটাই এখন সময়ের দাবি।
আপনার মতামত জানানঃ