
নারীরা কোথায় হারিয়ে গেল? বাংলাদেশের রাজনীতিতে, অর্থনীতি ও সমাজের সর্বস্তরে নারীর অবদানের কথা বললে দেখা যায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম প্রমাণ করছে, নারীদের কণ্ঠস্বরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবমূল্যায়ন ও উপেক্ষা করা হচ্ছে। সংরক্ষিত আসনে নারীদের মনোনয়ন সরাসরি নির্বাচনের বদলে মনোনীত প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখা হয়েছে, যা নারীর নেতৃত্ব বিকাশ ও ভোটারের প্রতি জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছিল। সেই সময় বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীরা, বিশেষ করে নারীরা, রাস্তায় নেমে ন্যায়বিচার ও অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করেছিলেন। কিন্তু হাসিনা-পরবর্তী সরকারের প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রশাসনের অংশ হয়ে ওঠা পুরুষ সহযোদ্ধারা তাদের বাদ দিয়ে দিল। আন্দোলনের কৃতিত্ব, যা বিভিন্ন স্তরের মানুষ—শিক্ষার্থী, শ্রমিক, নারী ও রাজনৈতিক দলের কর্মী—দিয়ে গঠিত ছিল, তা যেন একদম উপেক্ষিত হয়ে গেল।
মুহাম্মদ ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা বহু বছর ধরে নারী ক্ষমতায়নের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তবুও, তাদের প্রশাসনের অধীনে গঠিত নারী কমিশন (WARC) কার্যত নারীদের ক্ষমতা হ্রাসের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। নারী কমিশন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদের সঙ্গে আলোচনা করে, আইনি, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় নারীবিদ্বেষ ও বৈষম্য চিহ্নিত করে ৪২৩টি সুপারিশ তৈরি করেছিল। এতে গ্রামীণ নারী, নিম্ন-আয়ের শ্রমজীবী ও সংখ্যালঘু নারীর স্বার্থও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু উগ্র-ডানপন্থী ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর আক্রমণ এবং সরকারের নীরবতার কারণে এই উদ্যোগের কার্যকারিতা সীমিত হয়ে পড়ল।
নারী কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর অন্তর্বর্তী সরকার নারীদের সুপারিশকে গুরুত্ব দেয়নি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে ছয়টি কমিশনের সুপারিশ উপস্থাপন করা হলেও নারীদের প্রতিনিধি দলের প্রভাব প্রায় নেই। ৮০০টি সুপারিশের মধ্যে মাত্র ১৬৬টি আলোচিত হয় এবং ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়। সংরক্ষিত আসনে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে—৫০ থেকে ধীরে ধীরে ১০০ এবং সাধারণ আসনে ৫ শতাংশ নারীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে, যা ২০৪৩ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশে পৌঁছাবে। কিন্তু সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ নেই, যা বহু বছর ধরে নারী অধিকার আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল।
অর্থনীতিতে নারীর অবদানও অপরিসীম। পোশাকশিল্পে ৫৩ শতাংশ কর্মী নারী, প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে নারীর প্রেরিত রেমিট্যান্স বেশি। কৃষি শ্রমশক্তির ৫৮ শতাংশ নারী, যার মধ্যে ৪৫.৭ শতাংশ কোনো পারিশ্রমিক পান না। দীর্ঘদিন ধরে দেশের অর্থনীতি নারীর শ্রম ও দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। তবুও সরকারের পদক্ষেপ নারীদের এই অবদানের স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ।
FWPR (Forum for Women’s Political Rights) গঠিত হয় ২০২৫ সালের আগস্টে, যখন স্পষ্ট হয়ে যায়, নারীদের আকাঙ্ক্ষা ও বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রস্তাবনা সরকার কর্তৃক উপেক্ষিত হচ্ছে। FWPR-এর ন্যূনতম দাবি হলো ২০২৬ সালের জন্য ১০০টি সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ এবং সাধারণ আসনের ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থীর মনোনয়ন। তারা ১৯৭২ সালের রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার (RPO)-এ সংশোধনী প্রস্তাবও জোর দিয়ে বলেছে।
নারীর প্রতিনিধিত্ব শুধুমাত্র নারী বা নারীর অধিকারের বিষয় নয়; এটি ন্যায়, সমতা ও গণতন্ত্রের অখণ্ডতার প্রশ্ন। নারী কমিশনের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রম অধিকার, দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে জোরালো মত প্রকাশ করেছেন এবং অনেক সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্ব হলো নিশ্চিত করা, নারীরা জাতির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ হোক। জুলাই সনদ যদি নিজেকে ন্যায্য ও বৈষম্যহীন হিসেবে প্রমাণ করতে চায়, তবে নারীদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক।
বাংলাদেশের ইতিহাস দেখিয়েছে নারীরা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন—১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ এবং ২০২৪ সালের ঘটনাগুলোতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অন্তর্বর্তী সরকারের মনোভাব তাদের উপেক্ষা করে চলেছে। নারী কমিশনের সুপারিশ ও FWPR-এর দাবি উপেক্ষা করা হচ্ছে, অথচ জনগণ, বিশেষ করে নারীরা, পরিচ্ছন্ন, যোগ্য ও সেবায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রার্থীদের ভোট দিতে আগ্রহী।
সংক্ষেপে বলা যায়, নারীদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বঞ্চিত করা, তাদের নেতৃত্ব বিকাশ ও ভোটারদের প্রতি জবাবদিহি কমিয়ে আনা, এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের অবদানের স্বীকৃতি না দেওয়া—এই সব মিলিয়ে বর্তমান বাংলাদেশে নারীদের “হারিয়ে যাওয়া” প্রকৃতির চিত্র তুলে ধরছে। এটি শুধুমাত্র নারীর অধিকার বা রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয় নয়; এটি দেশের গণতন্ত্র, ন্যায়, সমতা ও অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে জড়িত। নারীরা নিজেরাই তাদের কণ্ঠস্বরকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে, সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন ও সাধারণ আসনে পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এবং রাষ্ট্রকে তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করছেন। এভাবে তারা বাংলাদেশের স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের জন্য একটি অগ্রণী শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করছেন।
সার্বিকভাবে, নারীরা এখনো হারায়নি—তবে তাদের অংশগ্রহণের বাধা ও উপেক্ষা প্রমাণ করছে যে, রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নারী রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা না হলে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সমাজের টেকসই উন্নয়ন প্রকৃতপক্ষে অসম্পূর্ণ থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ