
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় দলটির সমর্থক এবং তাদের ‘ভোটব্যাংক’কে ঘিরে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা অভাবনীয়ভাবে বেড়ে গেছে। ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠপর্যায়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরা বুঝতে পারছেন, আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সংগঠিত ভোটব্যাংক এবারের নির্বাচনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ দলটি নির্বাচনে থাকুক বা না থাকুক, তাদের সমর্থক ভোটাররা তো রয়েই গেছে। সেই ভোটারদের প্রতি আকর্ষণ তৈরির জন্য বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা নানা কৌশল, প্রতিশ্রুতি ও রাজনৈতিক বার্তা দিয়ে মাঠ গরম রাখছেন।
গোপালগঞ্জ—যা আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যবাহী ঘাঁটি এবং নৌকা প্রতীকের অনড় সমর্থন কেন্দ্র—সেখানেই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে জামায়াত ও বিএনপির। গোপালগঞ্জের তিনটি আসনেই দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। বিপুল ভোটে নৌকার জয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া ছিল এখানে নিয়মিত চিত্র। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ রাজনৈতিক কার্যক্রমের কারণে নির্বাচনের বাইরে থাকতে পারে বুঝেই এখানে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। জামায়াত ইতোমধ্যে তিনটি আসনেই সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে, তাদের মধ্যে গোপালগঞ্জ-২ আসনে আজমল হোসেন সরদার বিশেষভাবে সক্রিয়। ১৯৯৬ সালের পর দীর্ঘ বিরতি নিয়ে তিনি আবারও ভোটের মাঠে নেমেছেন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করছেন।
তিনি ভোটারদের বলছেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলে তারা নৌকাতেই ভোট দিতে পারেন, কিন্তু দলটি না থাকলে বিকল্প হিসেবে তাকে সমর্থন দেওয়ার অনুরোধও রাখছেন। একইসঙ্গে তিনি দাবি করছেন, নৌকার সমর্থকদের মামলা, হয়রানি ও ভয়ের পরিবেশ থেকে মুক্ত রাখতে জামায়াত কাজ করছে। বিশেষ করে গোপালগঞ্জে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনায় ২০–২৫টি মামলায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। এ অবস্থায় আজমল হোসেন সরদার বলছেন, তারা মানুষকে মিথ্যা মামলা ও হয়রানি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, এবং এ কারণে অনেক ভোটার তাদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
অন্যদিকে বিএনপিও গোপালগঞ্জে তৎপর, যদিও ঐতিহ্যগতভাবে এখানে তাদের তেমন শক্ত অবস্থান নেই। কিন্তু এবার তারা নতুন আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নেমেছে। গোপালগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী কে এম বাবর বলছেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না থাকলে জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে ধানের শীষকে সমর্থন দেবে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, বিএনপি যদি এখানে জিততে পারে তবে প্রতিশোধমূলক রাজনীতি, মিথ্যা মামলা বা হয়রানি করবে না। তারেক রহমানের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলছেন, ভালোবাসা ও ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের মন জয় করাই তাদের লক্ষ্য। তবে জামায়াতের প্রার্থীর অভিযোগের ইঙ্গিত পেলে কে এম বাবর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। তিনি জামায়াতকে ‘গুপ্ত সংগঠন’ বলে উল্লেখ করে বলেন, মিথ্যা মামলা বা হয়রানির পেছনে বিএনপি নয়, মূলত এনসিপি ও জামায়াতের কিছু অংশ জড়িত।
এনসিপি তৎপরতা তুলনামূলকভাবে কম হলেও তাদের রাজনৈতিক বার্তা ভিন্ন। গণঅভ্যুত্থানের নেতা হিসেবে উঠে আসা তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি মনে করে, আওয়ামী লীগের স্থায়ী কোনো ভোটব্যাংক এখন আর তেমন নেই; এটি দশ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব মনে করেন, আওয়ামী লীগের তরুণ সমর্থকদের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের সময় যে ‘ট্রান্সফরমেশন’ বা পরিবর্তন দেখা গেছে, তা ভোটারদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়বে। তিনি বলেন, সাবেক ছাত্রলীগ, ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত এনসিপির নতুন নেতৃত্ব মাঠে একটি বাস্তবসম্মত ও কাজনির্ভর রাজনীতি তুলে ধরছে। ফলে যারা একসময় বাধ্য হয়ে বা পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগ করতেন, তারা এখন চাইলে এনসিপি, বিএনপি কিংবা জামায়াতকে বেছে নিতে পারেন।
জামায়াতে ইসলামী এবার বিশেষ কৌশলে এগোচ্ছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, তাদের ভোটাররা এখনও আছে এবং তারা আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকদেরও কাছে টানতে চান। তিনি মনে করেন, যেসব আওয়ামী লীগ সমর্থক বড় কোনো অপরাধে জড়িত নন, তারা আসলে সাধারণ মানুষ; তারা শুধু দল করতেন। আওয়ামী লীগ নির্বাচন না করলে তাদের ভোট অন্যত্র যেতে পারে। তিনি বলছেন, মানুষ নিরাপত্তা, সততা ও সৎ চরিত্রের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে। জামায়াত হিন্দু ভোটারদের প্রতিও বিশেষভাবে তৎপর হয়েছে; সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে বড় সমাবেশও করেছে। পরওয়ারের ভাষায়, তারা কাউকে জোর করছেন না, বরং ভালোবাসা ও আদর্শের মাধ্যমে মানুষকে আকৃষ্ট করতে চাইছেন।
বিএনপিও তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন করেছে দলটি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, তাদের রাজনীতি বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর জন্য নয়—বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য। তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, উন্নয়নমূলক কর্মসূচি ও নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিই মানুষকে আকৃষ্ট করবে বলে তিনি মনে করছেন। তিনি বলেন, তারা ভোটব্যাংক কেন্দ্রীক রাজনীতি নয়, নীতি ও উন্নয়নকেন্দ্রিক রাজনীতি করতে চান।
এই সমগ্র তৎপরতায় যে বিষয়টি সবচেয়ে স্পষ্ট তা হলো—বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিবেশে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ভোটব্যাংকই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু। দলটি নির্বাচনে অনিশ্চিত থাকায় তাদের সমর্থকদের ভোট কোথায় যাবে, তা নির্বাচন ফলাফলের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি—তিনটি দলই বুঝে গেছে, নৌকার ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারলে বিজয়ের সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়বে। স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের ইতিবাচক বার্তা, মামলা থেকে মুক্তির আশ্বাস, সংখ্যালঘু ভোটারদের সঙ্গে সভা–সমাবেশ, এমনকি পারিবারিক সামাজিক সম্পর্ক—সবই এখন এই ভোটের রাজনীতির কৌশলের অংশ।
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মূল সমর্থকরা কোন পথে হাটবেন, তা অনেকটাই নির্ভর করছে দলটির হাইকমান্ডের ভবিষ্যৎ নির্দেশনার ওপর। বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মেরুকরণে নৌকার সমর্থকরা সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিলেন। এবার দলটি নির্বাচনে না থাকলে তাদের ভোটাররা যে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করবেন, তা দেশের আসন্ন নির্বাচনের গতিপথ নির্ধারণে এক বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ