রাজধানীর ব্যস্ত সোবহানবাগ এলাকার এক ফ্ল্যাটে কয়েক দিন আগেই নিঃশব্দে ঝরে গেল এক তরুণ প্রাণ—এক নারী গণমাধ্যমকর্মী, যিনি জীবনের লড়াই শেষ করেছিলেন নিজের হাতেই। মৃত্যুর খবরটি প্রথমে শোনা গিয়েছিল নিছক আরেকটি আত্মহত্যার খবর হিসেবে। কিন্তু দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে, এই মৃত্যুর পেছনে আছে একটি ভয়াবহ কর্মপরিবেশ, অবহেলা এবং হয়রানির দীর্ঘ ইতিহাস। তিনি ছিলেন অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা স্ট্রিমের একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। অফিসে নিয়মিতভাবে তার সহকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানের বাংলা কনটেন্ট এডিটর আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে একাধিক নারী সাংবাদিক লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগকারীদের সংখ্যা ছিল ২৬ জন, তাদের মধ্যে ৯ জন নারী। কিন্তু এসব অভিযোগ, প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের কাছে যেন কেবলই এক ‘অসুবিধাজনক তথ্য’।
বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি স্পষ্ট নির্দেশিকা আছে—২০০৯ সালে উচ্চ আদালত থেকে প্রণীত “যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা”। এতে বলা হয়েছে, অভিযোগ উঠলে প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে। কিন্তু ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষ এসব আইন ও নির্দেশিকাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। বরং অভিযোগকারীদের মানসিক চাপে রাখার অভিযোগও উঠেছে। প্রধান সম্পাদক গোলাম ইফতেখার মাহমুদ এবং মানবসম্পদ বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব ছিল অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তারা সেটি করেননি। এই নিষ্ক্রিয়তাই আজ এক তরুণীর মৃত্যুকে ‘ব্যক্তিগত দুর্বলতা’ নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধে পরিণত করেছে।
ঘটনাটি শুধু একটি অফিসের দেয়ালে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই ঘটনার পর দেশের ২৪৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক একযোগে বিবৃতি দিয়েছেন, যেখানে তাঁরা দাবি করেছেন সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিচারের। বিবৃতিটি গণমাধ্যমে পাঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা এবং কবি-সাংবাদিক গিরীশ গৈরিক। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্না, অর্থনীতিবিদ আব্দুল বায়েস, কবি নির্মলেন্দু গুণ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীনসহ অনেকে। তাঁরা সবাই এক কণ্ঠে বলেছেন—এই মৃত্যু কেবল এক ব্যক্তির নয়; এটি কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে শুধু নিন্দা নয়, আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থারও জবাবদিহি দরকার।
বাংলাদেশে এখন হাজারো নারী সাংবাদিক, প্রকৌশলী, ডিজাইনার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রতিদিন অফিসে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেই জানেন, কর্মক্ষেত্র সব সময় নিরাপদ নয়। তীক্ষ্ণ মন্তব্য, ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি, অনুপযুক্ত মেসেজ, কিংবা হুমকিমূলক আচরণ—এসব অনেক সময় আনুষ্ঠানিক অভিযোগে পরিণত হয় না। কারণ, অভিযোগ করলেই যে ন্যায়বিচার মিলবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। এই সংস্কৃতি কেবল মিডিয়া নয়, প্রায় সব পেশাতেই দৃশ্যমান। নারীরা যখন নিজেদের পেশাদার দক্ষতায় এগিয়ে যেতে চান, তখন তাঁদেরকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা হয়—মানসিকভাবে, সামাজিকভাবে, কখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। এই অসহায়তাই অনেক সময় মানুষকে এমন এক অন্ধকারে ঠেলে দেয়, যেখান থেকে ফেরার পথ থাকে না।
আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আটটি সুনির্দিষ্ট ঘটনার। প্রতিটি অভিযোগেই ছিল নারীর প্রতি অপমানজনক ও অনৈতিক আচরণের বিবরণ। কিন্তু এই অভিযোগের পরও প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায় থেকে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই ব্যর্থতা কেবল একজন সম্পাদক বা মানবসম্পদ কর্মকর্তার নয়—এটি পুরো প্রাতিষ্ঠানিক নীতিহীনতার প্রতিচ্ছবি। কর্মক্ষেত্রে হয়রানিকে “ছোটখাটো বিষয়” বলে উড়িয়ে দেওয়ার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তা আজ এক তরুণীর মৃত্যু দিয়ে সমাজের সামনে নির্মমভাবে উন্মোচিত হয়েছে।
গণমাধ্যমকে সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়—যে স্তম্ভ অন্যদের জবাবদিহির আওতায় আনে। কিন্তু যখন সেই গণমাধ্যম নিজেই হয়রানি, বৈষম্য ও অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে—এই স্তম্ভের ভেতরটা কতটা নৈতিকভাবে টেকসই? বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে নারী কর্মীদের হয়রানির অভিযোগ উঠলেও সেগুলোর অধিকাংশই নিষ্পত্তিহীন থেকে গেছে। বরখাস্তের বদলে অনেক সময় ভুক্তভোগীকেই চাকরি ছাড়তে হয়। এই নীরব অন্যায়ই আস্তে আস্তে পরিণত হয় সহনশীলতার সংস্কৃতিতে—যেখানে অপরাধীরা জানে, তাদের বিরুদ্ধে কিছুই হবে না।
২০০৯ সালের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই একটি “যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি” থাকার কথা। এই কমিটিতে নারী সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে অনেক প্রতিষ্ঠানেই এমন কমিটি গঠিত হয়নি। সরকারি অফিসেও এটি প্রায় অকার্যকর। ফলে, আইন কাগজে আছে, কিন্তু তার বাস্তব প্রয়োগ নেই। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশে ৭০ শতাংশ নারী কর্মী জীবনে অন্তত একবার কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হয়েছেন, কিন্তু তাদের মাত্র ৬ শতাংশ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেছেন। এই বৈষম্যই বোঝায়—ভয়ের সংস্কৃতি কত গভীরে প্রবিষ্ট।
এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। তরুণ সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং সাধারণ নাগরিকেরা লিখতে শুরু করেন “#JusticeForHer” হ্যাশট্যাগে। মানুষ প্রশ্ন তুলছে—কেন প্রতিবারই নারীর কণ্ঠরোধ হয়, কেন প্রমাণ দিয়েও বিচার পাওয়া যায় না, কেন প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের দায় এড়াতে পারে? ২৪৩ নাগরিকের বিবৃতি তাই কেবল একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নয়; এটি সমাজের বিবেক জাগানোর আহ্বান। কারণ, কোনো এক নারী যদি কর্মক্ষেত্রে ন্যায়বিচার না পায়, তাহলে তা কেবল তার নয়—আমাদের সকলের ব্যর্থতা।
এখন সময় এসেছে কেবল নিন্দায় নয়, পদক্ষেপে কথা বলার। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্বচ্ছ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে উদাহরণ সৃষ্টি হয়। প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি গঠন বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর করতে হবে। ভুক্তভোগীদের জন্য মানসিক সহায়তা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। গণমাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্যবিরোধী প্রশিক্ষণ নিয়মিত চালু করা উচিত, যাতে সচেতনতা তৈরি হয়।
এই তরুণীর নাম হয়তো ইতিহাসের পাতায় খুব বেশি জায়গা পাবে না। কিন্তু তার মৃত্যু একটি আয়না তুলে ধরেছে—যেখানে আমরা সবাই নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। এই মৃত্যু দেখিয়ে দিয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা এখনো নিশ্চয়তা পায়নি, আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই, এবং নীরবতা এখনো অনেকের কাছে নিরাপদ আশ্রয়। তবুও আশার জায়গা আছে—যে সমাজের ২৪৩ জন সচেতন নাগরিক, কবি, আইনজীবী, অধ্যাপক একসাথে কলম ধরেন একটি মৃত্যুর প্রতিবাদে, সেই সমাজ এখনো পুরোপুরি মৃত নয়। প্রশ্ন শুধু একটাই: এই জাগরণ কি একদিন আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলোকে সত্যিই নিরাপদ করে তুলবে?
আপনার মতামত জানানঃ