ভোরের আলো তখনও ঠিকমতো ফুটে ওঠেনি। ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনের ওপারের ওয়াশপিটে সারারাতের ধোয়া-মোছার কাজ প্রায় শেষের দিকে। লোকাল ট্রেনের কয়েকটি কোচ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, দিনের প্রথম যাত্রীদের অপেক্ষায়। এমন সময় নিস্তব্ধ ভোরকে ছিঁড়ে আচমকা ধোঁয়ার গন্ধ, তারপর আগুনের লেলিহান শিখা দেখা দেয় একটি বগিতে। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে গিয়ে আগুন নেভান, কিন্তু ততক্ষণে কয়েকটি সিট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো—বগির ভেতর ছড়িয়ে ছিল গানপাউডারের মতো দাহ্য মিশ্রণ, পাশাপাশি পাওয়া গেছে পেট্রল। যে উদ্দেশ্য নিয়ে দুর্বৃত্তরা এসেছিল, তা স্পষ্ট—স্টেশনে বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটানো।
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর তিনজন সদস্য তৎপরতার সঙ্গে আগুন নেভানোর পাশাপাশি কাছাকাছি থাকা একজন দুর্বৃত্তকে ধাওয়া করেন। কিন্তু অন্ধকার আর ফাঁকা স্টেশন এলাকা তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। ঘটনাটি খুব দ্রুত ঘটে, কিন্তু তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। কারণ এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেশের নানা জায়গায় বাস, গাড়ি, দোকানপাট থেকে শুরু করে রেললাইনের পাশে সন্দেহজনক আগুন লাগানোর ঘটনা বাড়ছে। আর এই অস্থিরতার ছায়া সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর আরও ঘনীভূত হয়েছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, রায় ঘোষণার পর দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ আবারও বেড়েছে। ঢাকার আদালত কক্ষে দেওয়া ঐতিহাসিক রায়টি একদিকে যেমন অনেকের কাছে ন্যায়বিচারের প্রতীক, অন্যদিকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বলয়ের কাছে এটি প্রতিশোধমূলক ষড়যন্ত্রের প্রতিচ্ছবি। আর ঠিক এই অবস্থার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ হঠাৎ আগুন লাগানোর ঘটনা নতুন করে আতঙ্ক তৈরি করছে। অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, এসব আগুন নিছক দুর্ঘটনা নয়; বরং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় কিছু সংগঠিত মহল অস্থিতিশীলতা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আগুনের ব্যবহার নতুন নয়। আন্দোলন, অবরোধ, প্রতিপক্ষকে দুর্বল করা—সবক্ষেত্রেই আগুনকে নানা সময় কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বাসে আগুন, ট্রেন লাইনচ্যুত করা, রেলপথে নাশকতা—এসবই ভয়াবহ এবং পুরোনো কৌশল। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের আন্দোলনকালে যেমন আগুন–সন্ত্রাস ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার সরঞ্জাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জনগণ জানে, একবার এই আগুনের রাজনীতি শুরু হলে তা থামতে সময় লাগে। ময়মনসিংহের সাম্প্রতিক ঘটনায় সেই পুরোনো অস্থিরতার ছায়াই যেন দেখা যাচ্ছে।
স্টেশনের বগির ভেতর যে গানপাউডার জাতীয় মিশ্রণ পাওয়া গেছে, তা ইঙ্গিত করে আগুন ছড়ানোর পরিকল্পনা ছিল আরও বিস্তৃত। শুধু সিট পোড়ানো নয়, বরং পুরো বগিতে আগুন ধরে গেলে যাত্রীবাহী এলাকায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, আগুন যদি কয়েক মিনিটও ছড়াতে পারত, তাহলে শুধু সম্পত্তিই নয়, প্রাণহানিও ঘটতে পারত। রেললাইনে এ ধরনের নাশকতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ দেশের বহু মানুষ প্রতিদিন এই পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল।
রাজনৈতিক উত্তেজনার সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা কতটা সম্পর্কিত? সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্লেষকদের আলোচনায় উঠে এসেছে—শেখ হাসিনার রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নতুন অস্থিরতার পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। তাঁর সরকারের সময়ে দীর্ঘদিন বিরোধী দল দমন-পীড়নের অভিযোগ, ছাত্র-যুবকদের ওপর হামলা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল। ফলে তাঁর অপসান ও রায় ঘোষণাকে একদল মানুষ রাষ্ট্রীয় শুদ্ধির প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছে। কিন্তু অন্য একটি শক্তিশালী অংশ এটিকে ক্ষমতা বদলের নামে রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে ব্যাখ্যা করছে।
এই দুই প্রবল বিপরীত মনোভাবের সংঘাতে উত্তেজনা বাড়া অস্বাভাবিক নয়। এবং যখন উত্তেজনা বাড়ে, তখন কিছু সংগঠিত গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে আগুন লাগানোকে সবচেয়ে সহজ, দ্রুত এবং ভয়াবহ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। বিশেষত রায় ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাও বেড়েছে। ফলে আতঙ্ক ছড়ানো, বিশৃঙ্খলা বাড়ানো এবং সরকারকে চাপের মুখে ফেলার সবচেয়ে প্রচলিত রাস্তাই হলো—আগুন।
গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাসে আগুনের ঘটনা ঠিক একই ধাঁচের। যাত্রী নামানোর পর বা ফাঁকা রাস্তায় চলন্ত বাসে আগুন লাগানো হচ্ছে। হঠাৎ পার্কিংয়ের জায়গায় একাধিক গাড়ি পুড়ে যাচ্ছে। এসবের কোনো স্পষ্ট দাবি বা দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না, আবার বিশেষ তদন্তও কোনো পক্ষকে নির্দিষ্ট করে দোষী করছে না। কিন্তু যেহেতু নির্বাচন, ক্ষমতা পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস চলছে—তাই এই ঘটনাগুলোকে খুবই স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের ঘটনাও সে–ধারণাকে আরও জোরালো করে। কারণ স্টেশন এলাকা সাধারণত মানুষের ভিড় হয়, নিরাপত্তা থাকে, এবং রেল পরিবহন একটি জাতীয় অবকাঠামোগত সম্পদ। কোনো আন্দোলন বা প্রতিপক্ষকে চাপ দিতে হলে রেল বা পরিবহনে আগুন লাগানো সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এতে জনমানুষের আতঙ্ক বাড়ে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে, এবং সরকারকে ব্যর্থ দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়।
এ ধরনের নাশকতামূলক কাজে সাধারণত দুই ধরনের উদ্দেশ্য থাকে—প্রথমত, জনমনে ভয় সৃষ্টি করা যাতে গণপরিবহন ব্যবহারে সংকোচ তৈরি হয়; দ্বিতীয়ত, সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ানো। বিশেষ করে শেখ হাসিনার রায়ের মতো একটি বড় রাজনৈতিক ঘটনার পরে যেসব মহল নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত মনে করছে, তারা বিষয়টিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে—এমন সন্দেহ জোরালো হয়েছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখছে। রেল পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মনে করছেন, এ ঘটনা ছিল একটি ‘টেস্ট রান’—অর্থাৎ বড় কিছু ঘটানোর আগে পরীক্ষা বা প্রস্তুতি। কারণ দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়েই পালায়নি; বরং মিশ্রণ ছড়িয়ে রেখে গেছে। এটি নির্দেশ করে উচ্চমাত্রার পরিকল্পনা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ুক এবং ভয়াবহ ক্ষতি হোক। আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে ঘটনাটি হয়তো দেশের সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় রেল দুর্ঘটনায় রূপ নিত।
রাজনৈতিক সহিংসতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আগুনের ব্যবহার সাধারণত প্রতীকী নয়, বরং কৌশলগত। আগুন ছড়িয়ে পড়ে, নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, জনমনে তাৎক্ষণিক ভয় তৈরি করে এবং সরকারের প্রশাসনিক সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই রাজনৈতিক অস্থিরতার মুহূর্তে আগুন হয়ে ওঠে সস্তা কিন্তু শক্তিশালী অস্ত্র।
ময়মনসিংহের ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখা জরুরি। শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর তাঁকে ভারত ফেরত দেবে কি না—এ নিয়ে কূটনৈতিক টানাপোড়েনও চলছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখনো ঠাণ্ডা। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কেবল দেশীয় শক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আঞ্চলিক ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক চাপ, অর্থনৈতিক সংকট এবং ক্ষমতা–বদলের রাজনৈতিক আবহ।
এসব পরিস্থিতিতে আগুন লাগানো কেবল নাশকতা নয়; এটি রাজনৈতিক বার্তা। এ বার্তা হতে পারে—দেশকে স্থিতিশীল হতে দেওয়া হবে না। আবার এটি হতে পারে—শক্তির প্রদর্শন। কিংবা সরকারকে সংকটে ফেলার এক প্রচেষ্টা। যে উদ্দেশ্যই থাকুক, সাধারণ মানুষের জীবন ও দেশের সার্বিক নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে।
রেলস্টেশনের ঘটনাটি তাই শুধু একটি বগিতে আগুন লাগানোর ঘটনা নয়; এটি দেশের রাজনৈতিক উত্তাপের এক প্রতিফলন। যদি এসব আগুনের পেছনে সংগঠিত মহল থাকে, তবে তা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। আর যদি এটি স্বতন্ত্র কোনো গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তৎপরতা হয়, তবে সেটিও ভয়ংকর। দুই ক্ষেত্রেই স্পষ্ট—বাংলাদেশ এখন এক সংবেদনশীল রাজনৈতিক পথচলায় রয়েছে। এখানে আগুন দিয়ে সংকেত পাঠানোই যেন নতুন কিছু গোষ্ঠীর কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগামী কয়েক মাস—বিশেষ করে রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস এবং নির্বাচনের সময়—দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়তে পারে। তাই দরকার দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য তদন্ত, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ এবং জনসচেতনতার উন্নয়ন। কারণ আগুন লাগানো কখনোই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান নয়; বরং তা সমাজকে অস্থির করে, অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এবং সবচেয়ে বড় কথা—মানুষের মনে গভীর আতঙ্ক তৈরি করে।
ময়মনসিংহের সেই ভোরের আগুন তাই কেবল একটি অপরাধ নয়; এটি একটি সংকেত। এবং সেই সংকেতকে গুরুত্ব না দিলে দেশের পরিস্থিতি আরও জটিলতার দিকে এগোতে পারে। এই উত্তপ্ত রাজনৈতিক সময়ে আগুনের রাজনীতি যে আবার মাথা তুলছে—তা এখনই স্পষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো—কীভাবে এবং কত দ্রুত এ আগুনকে ছড়ানোর আগেই থামানো সম্ভব?
আপনার মতামত জানানঃ