
ভারত নিজেদের তৈরি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ফাঁদে সত্যিই কতটা জড়িয়ে গেছে—দিল্লির লালকেল্লার কাছে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বিস্ফোরণ সেই প্রশ্নটাই নতুন করে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। সন্ত্রাসবাদী হামলার পর ভারতের অবস্থান সাধারণত খুব স্পষ্ট থাকে—পাকিস্তানকে দায়ী করা, সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদকে কাঠগড়ায় তোলা এবং কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানোর হুমকি। কিন্তু এবারের হামলার পর ঘটনাপ্রবাহ একেবারেই ভিন্ন। বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত, ২০ জন গুরুতর আহত, শহরের কেন্দ্রস্থলে বিশাল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধারের মতো ঘটনা ঘটলেও সরকার তড়িঘড়ি করে পাকিস্তানের নাম নেয়নি, সীমান্তপারের ‘অপকর্ম’ হিসেবে আঙুলও তোলে না। এতে শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই নয়, ভারতীয় গণমাধ্যমও বিস্মিত।
এই বিস্ময়ের পেছনে যে জটিল বাস্তবতা কাজ করছে, তা মূলত গত কয়েক মাসে হঠাৎ বদলে যাওয়া আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপট। ভারতের পুরোনো অবস্থান ছিল—যে কোনো সন্ত্রাসী হামলা মানেই সীমান্তপারের ‘অ্যাক্ট অব ওয়ার’। পেহেলগামের হামলার পর মোদি সরকার ঘোষণা করেছিল, ভবিষ্যতের যে কোনো হামলাকে তারা ‘যুদ্ধ’ হিসেবে দেখবে এবং ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো প্রতিশোধমূলক সামরিক অভিযান চালাতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু সেই দৃপ্ত ঘোষণা এখন সরকারের জন্যই নিদারুণ সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, দিল্লির বিস্ফোরণকে যদি ‘অ্যাক্ট অব ওয়ার’ বলা হয়, তাহলে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হবে প্রতিশোধমূলক সামরিক অভিযান চালানোর। অথচ বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সেই অভিযান চালানো ভারতের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কথা ছিল ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদেও। কিন্তু গত কয়েক মাসে সেই সম্পর্কের গতিপথ নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। শাহবাজ শরিফ ও আসিম মুনিরের প্রশংসায় ট্রাম্পের কণ্ঠ যেমন উচ্ছ্বসিত, তেমনই নিস্তব্ধতা দেখা যাচ্ছে ভারতের প্রতি তাঁর আগ্রহে। পাকিস্তান–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের এই নতুন উষ্ণতা ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করেছে। একই সঙ্গে তুরস্কও পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা সমীকরণকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
এই বাস্তবতায় যদি ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং যুদ্ধের ঘোষণা অনুযায়ী সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে ওয়াশিংটন ও আঙ্কারার অবস্থান ভারতের বিরুদ্ধে যেতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। নতুন সামরিক সংঘাত সেই আলোচনা পুরোপুরি ভণ্ডুল করে দিতে পারে। ভারতের অর্থনীতি বর্তমানে যে চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেই অবস্থায় যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে সরকার চাইছে না।
এমন পরিস্থিতিতে মোদি সরকারের নীরবতা যেন এক ধরনের বাধ্যতামূলক কূটনৈতিক আত্মসংযম। সন্ত্রাস দমন আইন ইউএপিএর আওতায় মামলা হয়েছে, এনআইএ তদন্ত শুরু করেছে—এসব প্রশাসনিক পদক্ষেপই সরকারের একমাত্র প্রতিক্রিয়া। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কোথায়? সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদকে যাদের বিরুদ্ধে এতদিন সবচেয়ে বেশি সুর চড়ানো হতো, সেই পাকিস্তানের নামই এখন সরাসরি উচ্চারণ করতে পারছে না সরকার।
বিরোধীরা এই অবস্থানকে সরকার বিরোধী প্রচারে ব্যবহার করছে। কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরা, এএপি নেতা সঞ্জয় সিং—সবাই একই প্রশ্ন তুলছেন: এত বড় হামলা ঘটল, ১১ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও মোদি সরকার এত অসহায় কেন? যদি পাকিস্তান দায়ী না হয়, তাহলে কে দায়ী? আর যদি সন্দেহ থাকে, তাহলে ‘অ্যাক্ট অব ওয়ার’ হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে না কেন? জনগণ সরকারের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় থাকলেও সেই প্রতিক্রিয়া আসছে না—প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু নয়।
এই অসহায়তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি। তাঁর মতে, ভারত তাদের ঘোষিত রণনীতির ফাঁদেই আটকা পড়েছে। ‘অ্যাক্ট অব ওয়ার’ ধারণাটা মূলত ছিল রাজনৈতিক শ্লোগানসুলভ। এর বাস্তবায়নযোগ্যতা, কৌশলগত পরিণতি কিংবা সামরিক প্রস্তুতি সম্পর্কে সরকার ভেবে দেখেনি। ফলে আজ যখন একই অবস্থানে দাঁড়াতে হচ্ছে, তখন বাস্তবিক ও কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতা সামনে এসে পড়েছে।
তবে সরকারের সমস্যাটা কেবল রণনীতির ফাঁদে পড়া নয়; আরও বড় সমস্যা হলো—দুই প্রতিবেশী পরমাণু শক্তির রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়লে তা চীনকেও প্রভাবিত করতে পারে। ভারত এমনিতেই লাদাখ সীমান্তে চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থায় আছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন আরেকটি সীমান্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে ভারতের সামরিক সক্ষমতার ওপর অপ্রত্যাশিত চাপ তৈরি হবে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ভারতের নীরবতা পাকিস্তানের প্রতি নমনীয়তা দেখানো। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, তুরস্ক এবং বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বাধ্যবাধকতা। মোদি সরকার বুঝতে পারছে, এখন কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিলে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া কঠিন হবে, বরং অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ বাড়বে।
এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নীতি বিশেষজ্ঞদের বড় প্রশ্ন—এটা কি কেবল সাময়িক প্রতিশ্রুতি, নাকি বাস্তব পদক্ষেপের সূচনা? সরকারের ভেতরেই যে সংশয় কাজ করছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মন্ত্রিসভার বৈঠকের বিবৃতি থেকে। সেখানে বিস্ফোরণকে ‘দেশবিরোধী শক্তির কাজ’ বলা হলেও পাকিস্তানের নাম পরিহার করা হয়েছে অত্যন্ত সচেতনভাবে।
গত এক দশকে মোদি সরকারের শক্ত অবস্থানের যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল—‘দৃঢ় নেতা’, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর’, ‘শত্রু রাষ্ট্রকে আঘাত করতে পিছপা নয়’—দিল্লির বিস্ফোরণ সেই রাজনৈতিক ব্র্যান্ডকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। কারণ প্রথমবার ভারতকে প্রতিক্রিয়ার চাপে পশ্চাদপসরণ করতে দেখা যাচ্ছে।
এমনকি বিজেপির ভেতরেও এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু—ঘোষিত রণনীতি কি আদৌ বাস্তবসম্মত ছিল? একটি রাষ্ট্রকে প্রতিটি সন্ত্রাসী হামলার পর ‘অ্যাক্ট অব ওয়ার’-এর ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া জানাতে হলে কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে প্রচণ্ড চাপ মোকাবিলা করতে হয়। তার ওপর আন্তর্জাতিক মিত্ররা যদি নিরপেক্ষ থাকে কিংবা প্রতিপক্ষের দিকে ঝুঁকে যায়, তাহলে পরিস্থিতি আরও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে।
এই বাস্তবতায় একটা বিষয় পরিষ্কার—ভারত শুধু পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলার রাজনৈতিক সুযোগ হারাচ্ছে না, বরং নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কাঠামো নিয়েও কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়ছে। দিল্লির মতো নিরাপত্তা-সতর্ক এলাকায় এত বড় বিস্ফোরক ঢুকে পড়ল কীভাবে? গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা কতটা প্রকট? এনআইএ তদন্ত শেষ পর্যন্ত কী উদ্ঘাটন করে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।
কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা এত সহজে সারানোর নয়। বিরোধীরা আগামী নির্বাচনের প্রচারণায় এই বিষয়টিকে বড় ইস্যু বানাবে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। মোদি সরকারের প্রতিক্রিয়া, নীরবতা এবং অস্পষ্ট অবস্থান আগামী কয়েক মাসে ভারতের রাজনৈতিক কথোপকথনের কেন্দ্রে থাকবে।
মোটকথা, দিল্লির বিস্ফোরণ শুধু একটি সন্ত্রাসী ঘটনা নয়; এটি ভারতের ঘোষিত যুদ্ধনীতি, কূটনৈতিক অবস্থান, আঞ্চলিক সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ঘাটতিকে একই সঙ্গে উন্মোচিত করেছে। এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে—শক্ত অবস্থানের রাজনীতি বাস্তব ভূরাজনীতির স্রোতে দাঁড়িয়ে স্থায়ী থাকে না। সরকার যদি ঘোষণা করে ‘যুদ্ধ’, তাহলে তাকে বাস্তবে যুদ্ধ করার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হয়। আর সেই প্রস্তুতি যদি না থাকে, তাহলে দৃপ্ত শ্লোগানই শেষ পর্যন্ত ফাঁদে পরিণত হয়। ভারত ঠিক সেরকম এক ফাঁদের ভেতরেই এখন বন্দী হয়ে পড়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ