ভূমিকম্প পৃথিবীর ভেতরে গভীর অস্থিরতার এক ভয়াবহ প্রকাশ। গত কয়েক বছরে মরক্কো, তুরস্ক–সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিধ্বংসী ভূমিকম্প আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে, মানুষ এখনো এই দুর্যোগের সামনে অসহায়। ঘুমন্ত মানুষের মাথার ওপর বাড়িঘর ভেঙে পড়ার সেই মুহূর্তগুলো যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—ভূমিকম্প আগে থেকে জানার ক্ষমতা এখনও বিজ্ঞানের নাগালের বাইরে। অথচ প্রতিটি বড় কম্পনের পরই প্রশ্ন ওঠে: আমরা কি কোনোদিন ভূমিকম্প হওয়ার আগে থেকে জানতে পারব?
এই প্রশ্নের ভিতরেই আছে মানুষের স্বাভাবিক ভয়, বাঁচার তাগিদ, আর বিজ্ঞানকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভূমিকম্প একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ার ফল, যা পৃথিবীর ভিতরের টেকটোনিক প্লেটগুলোর অদৃশ্য নাচনের ওপর নির্ভর করে। প্লেটগুলোর সংঘর্ষ, সরে যাওয়া বা ঘর্ষণের ফলে জমে থাকা চাপ যখন ফেটে বের হয়, তখনই ঘটে ভূমিকম্প। সমস্যাটি হলো, এই চাপ ঠিক কবে, কোথায় এবং কী মাত্রায় ছাড়বে—এটি নিশ্চিতভাবে বলা এখনো সম্ভব হয়নি।
১৯৭০ সাল থেকে তুরস্ক–সিরিয়া সীমান্তের সেই অঞ্চলে মাত্র তিনটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছিলেন যে সেখানে আরেকটি বড় কম্পন “বাকি” রয়েছে। কিন্তু কখন হবে, তা কেউ জানতেন না। টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর জটিলতা জমে থাকে, যেখানে শতশত কিলোমিটারজুড়ে অগণিত ছোট-বড় চ্যুতি বা ফল্ট লাইন মিলেমিশে থাকে। একটি জায়গার চাপ কমলে অন্য জায়গায় বাড়ে, আবার কোনো অংশ আকস্মিকভাবে সরে গেলে তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। এই জটিলতার ভিড়ে ছোট ছোট সংকেত খুঁজে পাওয়া যেমন কঠিন, তার থেকে পূর্বাভাস তৈরি করা আরও কঠিন।
তবু মানুষ আশা ছাড়েনি। আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূমিকম্প আগাম ধরার চেষ্টা চলছে অন্তত ৬০ বছর ধরে। কিন্তু সফলতা এখনো খুব সীমিত। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষামূলক “ভূমিকম্প” ঘটিয়ে গবেষকরা দেখেছেন, চ্যুতিতে প্রথমে ক্ষুদ্র ফাটল তৈরি হয়, চাপ বাড়তে থাকে, তারপর ত্রুটি ভেঙে কম্পন সৃষ্টি করে। বাস্তব পৃথিবীতেও কি একই রকম সংকেত আমরা ধরতে পারি? বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমস্যাটি হলো—প্রকৃতির আওয়াজ খুব বেশি। ট্রাফিক, নির্মাণকাজ, ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহ, বায়ুর চাপ—সব মিলিয়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরের সূক্ষ্ম শব্দগুলো ডুবে যায় দৈনন্দিন কোলাহলের নিচে। ফলে সত্যিকারের ভূমিকম্পের সংকেত ঠিক কোনটি, তা ধরা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার মতে, ভূমিকম্পের আদর্শ পূর্বাভাসে তিনটি তথ্য দরকার—কোথায় ঘটবে, কখন ঘটবে এবং কত বড় হবে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশ বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই তিনটি তথ্য নিশ্চিতভাবে দিতে পারেনি। তাই বিজ্ঞানীরা আপাতত সম্ভাব্যতা-ভিত্তিক “প্রাকৃতিক বিপদ মানচিত্র” তৈরি করেন, যেখানে বছরের ভিত্তিতে কোন এলাকায় বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা কত—তা হিসাব করা থাকে। এটি নির্মাণকাজে সাহায্য করে, ভবনকে অধিকতর ভূমিকম্প-সহনীয় করা যায়, কিন্তু আগে থেকে মানুষ সরিয়ে নেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এটি যথেষ্ট নয়।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোরও সমস্যা আছে। ১৯৭০–৮০ দশকে শুরু হওয়া শক্তিশালী ভূকম্পন কোড অনুযায়ী ভবন তৈরি করা ব্যয়বহুল। আর দরিদ্র বা মাঝারি আয়ের দেশে, যেখানে পুরনো ভঙ্গুর ভবনে মানুষ থাকে, সেখানে উন্নয়ন আরও কঠিন। তুরস্ক ও সিরিয়ার সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞে দেখা গেছে, দুর্বল অবকাঠামো ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
তবু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় নতুন আলো এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাত ধরে। এআই এখন এমন সূক্ষ্ম সংকেত শনাক্ত করতে পারে, যা মানুষ বা প্রচলিত যন্ত্র ধরতে পারে না। মেশিন-লার্নিং অ্যালগরিদম ভূমিকম্পের পূর্বের কম্পন, ত্রুটির শব্দ, ক্ষুদ্র গঠনগত পরিবর্তন—এসব বিশাল ডেটা বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য প্যাটার্ন শনাক্ত করতে পারে। পরীক্ষাগারে এই পদ্ধতি সফল হয়েছে—ফল্ট লাইন ভাঙার কয়েক সেকেন্ড বা মিনিট আগে সংকেত ধরা যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে পৃথিবীর ভেতর অসংখ্য জটিলতা—যার কারণে এই প্রযুক্তি এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে মাঠে প্রয়োগ করা যায়নি।
চীন আয়নমণ্ডলের বৈদ্যুতিক বিশৃঙ্খলা ধরে ভূমিকম্পের পূর্বাভাসের চেষ্টা করছে। তাদের স্যাটেলাইট সিসইএসের তথ্য অনুযায়ী, বড় ভূমিকম্পের ১০–১৫ দিন আগে আয়নমণ্ডলে ইলেকট্রনের ঘনত্ব কমে গেছে—এমন কিছু উদাহরণ পাওয়া গেছে। আবার ইসরায়েলের একটি গবেষণা বলছে, তারা ৮৩% নির্ভুলতায় ৪৮ ঘণ্টা আগে বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পেরেছে। তবে অন্য অনেক বিজ্ঞানী বলছেন, এই গবেষণাগুলো এখনও বিতর্কিত এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আসেনি। কারণ একই পরিবর্তন অন্য গোলার্ধেও দেখা যেতে পারে, অথবা কম্পনের কেন্দ্রস্থল থেকে অনেক দূরেও আয়নমণ্ডলে প্রভাব দেখা যেতে পারে।
জাপানে কেউ কেউ দাবি করছেন, ভূমিকম্পের আগের মাসে জলীয় বাষ্পের পরিবর্তন হয়—কিন্তু সেটিও কেবল আনুমানিক সময় দেয়, নির্দিষ্ট দিন নয়। কিছু দল আবার পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের ক্ষুদ্র তরঙ্গ ধরার চেষ্টা করছে, যেগুলো বড় চ্যুতি সরে যাওয়ার আগেই তৈরি হতে পারে।
এতগুলো গবেষণা চললেও এখন পর্যন্ত কোনো দেশের কাছে কার্যকর ভূমিকম্প “পূর্বাভাস” ব্যবস্থা নেই। বরং কিছু ক্ষেত্রে কেবল “প্রাথমিক সতর্কতা” বা early warning দেওয়া সম্ভব—যেখানে ভূমিকম্প শুরু হওয়ার পর ১০–৩০ সেকেন্ড আগে সতর্কবার্তা পৌঁছে যায়। এতে মানুষ অন্তত আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু এটি পূর্বাভাস নয়—এটি মাত্র প্রতিক্রিয়ামূলক ব্যবস্থা।
ভূমিকম্পের পরবর্তী ধাপ—অর্থাৎ আফটারশক শনাক্ত করা এবং কোন স্থাপনা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তা নির্ধারণে এআই আরও তাৎক্ষণিকভাবে সাহায্য করতে পারে। চীন এবং জাপানের কিছু দল স্যাটেলাইট ছবিতে ধ্বংসের মাত্রা শনাক্ত করতে এআই ব্যবহার করছে, যাতে দ্রুত উদ্ধার পরিকল্পনা নেওয়া যায়। এটি মানুষকে বাঁচাতে বাস্তবসম্মতভাবে বেশি সহায়ক হতে পারে।
তাহলে প্রশ্ন হলো—মানুষ কি কোনোদিন ভূমিকম্প আগে থেকে জানতে পারবে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাত্ত্বিকভাবে এটি অসম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ এত বিশাল যে, নিকট ভবিষ্যতে এর সফলতা খুব কঠিন। পৃথিবীর প্রতিটি ফল্ট লাইন মনিটর করার মতো পরিকাঠামো নির্মাণে অগণিত খরচ প্রয়োজন, এবং এত বিশাল জায়গায় সূক্ষ্ম সংকেত নিখুঁতভাবে শনাক্ত করা প্রযুক্তিগত দিক থেকেও কঠিন। তাছাড়া ভুল পূর্বাভাস দিলে পুরো শহর খালি করার মতো সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিকভাবে ভয়াবহ হতে পারে। তাই পূর্বাভাস যতক্ষণ না ৯০–১০০% নির্ভুল হয়, ততক্ষণ সরকারগুলোও সেই তথ্যের ওপর নির্ভর করতে চাইবে না।
বিজ্ঞানীরা অবশেষে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে আশার আলো দেখেন। আজ থেকে ৫০–৬০ বছর আগে ঝড়-বাদলের পূর্বাভাসও ছিল অনিশ্চিত। এখন স্যাটেলাইট, সুপার কম্পিউটার ও মডেলিং প্রযুক্তির কারণে ঝড়ের গতিপথও ৫–৭ দিন আগে জানা যায়। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে এমন উন্নতি একদিন সম্ভব—তবে সেই দিন এখনো অনেক দূরে।
সব মিলিয়ে বলা যায়—ভূমিকম্প science-এর সবচেয়ে কঠিন ধাঁধাগুলোর একটি। মানুষ হয়তো সম্পূর্ণ সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস আর কখনোই পাবে না, আবার হয়তো একদিন এআই-সহ উন্নত প্রযুক্তি সেই অসম্ভবকেও সম্ভব করবে। এখন পর্যন্ত যে সত্য স্পষ্ট—ভূমিকম্প প্রতিরোধ নয়, ক্ষতি কমানোই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শক্তিশালী অবকাঠামো, সচেতনতা, দ্রুত উদ্ধার ব্যবস্থা—এসবই এখন মানুষের হাতে থাকা কার্যকর অস্ত্র। পৃথিবীর ভেতরের অস্থিরতা রোধ করা না গেলেও, এর ক্ষতি কমিয়ে জীবন রক্ষা করার পথ আমাদেরই বানাতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ