বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতার পালাবদল এবং দেশের শীর্ষ নেতৃত্বকে ঘিরে নানা বিতর্ক ও অনুসন্ধানের মধ্যেই নতুন করে আলোচনায় এসেছে অগ্রণী ব্যাংকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লকার থেকে উদ্ধারকৃত বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকারের ঘটনা। রাজধানীর দিলকুশাস্থ প্রধান শাখায় অবস্থিত ৭৫১ ও ৭৫৩ নম্বর দুটি লকার ভাঙার পর মোট ৮৩২ ভরি স্বর্ণ পাওয়ার খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন—সবখানেই ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। এই ঘটনা শুধু স্বর্ণ উদ্ধারের বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এতে উঠে আসছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ব্যক্তিদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর কার্যক্রম, এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আইনগত প্রক্রিয়া নতুন করে সক্রিয় হওয়া—সবকিছু একসঙ্গে।
বিষয়টি শুরু হয় গত ১৭ সেপ্টেম্বর, যখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) লকার দুটি জব্দ করে। এরপর আইনানুগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আদালতের অনুমতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইসি কর্মকর্তারা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং অগ্রণী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে লকার ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে সিল করা অবস্থায় থাকা লকার ভাঙার মুহূর্তটি ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং নজরকাড়া—কারণ এর ভেতরে কী থাকতে পারে তা নিয়ে সবাই নানান জল্পনা-কল্পনা করছিল। অবশেষে লকার দুটি খোলা হলে উন্মোচিত হয় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকারের সন্ধান, যা সংখ্যা হিসেবে ৮৩২ ভরি। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পদের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অংক, যা স্বাভাবিকভাবেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
লকারে ঠিক কী ধরনের স্বর্ণ ছিল—বার, অলংকার নাকি বিশেষ কোনো সংগ্রহ—সেসব বিষয়ে এখনো বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। সিআইসির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জব্দ তালিকা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। জানা গেছে, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র বা মূল্যবান জিনিসপত্রও থাকতে পারে, যার সবকিছুই এখন রাষ্ট্রীয় সংস্থার হেফাজতে। এসব তথ্য আগামী দিনে আরও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম অবশ্য বলেছেন, লকার ভাঙার ঘটনা সম্পর্কে তিনি জানতেন, কিন্তু ভেতরে কী পাওয়া গেছে সে বিষয়ে তার বিস্তারিত জ্ঞান নেই। এই মন্তব্য ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ গোপনীয়তা রক্ষা নীতির দিকেই ইঙ্গিত করে।
এই ঘটনাটি শুধু অগ্রণী ব্যাংকেই সীমাবদ্ধ নয়। এর আগে, গত ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মতিঝিলের সেনা কল্যাণ ভবনে অবস্থিত পূবালী ব্যাংকের করপোরেট শাখায় শেখ হাসিনার আরেকটি লকার জব্দ করা হয়। ওই শাখায় তার দুটি ব্যাংক হিসাবেও টাকা পাওয়া যায়—একটিতে ১২ লাখ টাকার এফডিআর এবং আরেকটিতে ৪৪ লাখ টাকা, যা পরে এনবিআর জব্দ করে। এই তথ্যগুলো একত্রে বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয় যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক কর্মকাণ্ড এবং সম্পদসমূহ এখন বিভিন্ন সংস্থার নজরদারিতে রয়েছে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি এমন একটি পর্যায়ে রয়েছে যেখানে দুর্নীতি, সম্পদ জব্দ, এবং অতীত ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে। ইতিহাস বলছে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রায় প্রতিটি সরকারের ক্ষেত্রেই এমন আইনগত অনুসন্ধান ও তদন্ত শুরু হয়—কখনো তা বাস্তবিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে, আবার কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও সমালোচনা হয়। এই ঘটনাও সেই আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা দীর্ঘ ১৫ বছর (২০০৯–২০২৪) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সেই দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা, নীতি নির্ধারণ, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে কেন্দ্রীয়। তার ব্যক্তিগত সম্পদ, লকার, ব্যাংক হিসাবকে কেন্দ্র করে তদন্ত—সবই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীর আলোচনার জন্ম দেয়।
এ ধরনের ঘটনায় সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়াও বহুমুখী। অনেকে এটিকে আইনের স্বাভাবিক প্রয়োগ বলছেন—ক্ষমতায় থাকাকালীন বা ক্ষমতা হারানোর পর যেই হোন না কেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থা যদি মনে করে কোনো অনিয়ম বা গোপন সম্পদ রয়েছে, তবে তা অনুসন্ধান করাই তাদের দায়িত্ব। আবার কিছু অংশ মনে করেন, যে কোনো বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অতীত নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি পরিচিত ধারা। ফলে এসব তদন্ত কতটা নিরপেক্ষ বা উদ্দেশ্যমূলক—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে যখন ঘটনাটি একটি জনপ্রিয় ও আলোচিত রাজনৈতিক নেত্রীকে কেন্দ্র করে।
স্বর্ণের এই বিপুল পরিমাণ উদ্ধার নিয়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এ ধরনের মূল্যবান সম্পদ লকারে রাখা খুবই সাধারণ প্রথা। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত—অনেকেই নিরাপত্তার কারণে স্বর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ নথি ব্যাংকে সংরক্ষণ করেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটি কঠোরভাবে অপরাধমূলক নয়, বরং সম্পদের উৎস এবং ঘোষণা-সংক্রান্ত নিয়মের ওপরই নির্ভর করে বিষয়টি। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর তদন্ত মূলত এই দিকগুলোকেই যাচাই করবে—স্বর্ণের উৎস বৈধ কিনা, সম্পদ ঘোষণা করা হয়েছিল কি না, ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে কি না, কিংবা এসব সম্পদের সঙ্গে অন্য কোনো প্রক্রিয়া জড়িত ছিল কিনা।
তবে আরেক দিক হলো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ঘিরে অভিযোগ তোলা, সম্পদ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা প্রায়ই দেখা যায়। ফলে এই ঘটনাও নিশ্চয়ই নির্বাচনী রাজনীতি, গণমাধ্যমের আলোচনায় এবং বিভিন্ন দলের বক্তব্যে প্রতিফলিত হবে। রাজনৈতিক যুদ্ধে প্রমাণপত্রের মূল্য অনেক, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মূল্য ‘ধারণার রাজনীতির’। একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করা, কিংবা জনমনে প্রশ্ন জাগানো—এসবই বিরোধী দলগুলো কাজে লাগাতে পারে। আবার সরকারপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তদন্তের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে।
এদিকে, শুধুমাত্র এই একটি ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরও অনেক বড় পরিবর্তনের মধ্যেই দেশ এগোচ্ছে। একই দিনে প্রকাশিত আরেকটি খবর দেশে এবং বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জন্য পোস্টাল ব্যালট চালুর ব্যাপক সাড়া পাওয়ার কথা জানায়। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় ৩৩ হাজার প্রবাসী প্রথমবারের মতো বিদেশ থেকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এই পদক্ষেপটি যেমন বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা এনেছে, তেমনি দেশে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রও বিস্তৃত করছে। ফলে বোঝা যায়—একদিকে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও তদন্ত, অন্যদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন উদ্যোগ—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন বহুধাবিভক্ত, পরিবর্তনশীল এবং বহুস্তরীয়।
শেখ হাসিনার লকার থেকে উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের ঘটনা শুধু একটি আর্থিক অনুসন্ধানই নয়; এটি রাজনৈতিক ইতিহাস, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, আইনি কাঠামো এবং জনমানসে নেতৃত্ব সম্পর্কে ধারণার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এটি দেখতে হবে বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে—রাষ্ট্রের ক্ষমতা পরিবর্তনের পর স্বচ্ছতা নিশ্চিত হওয়া জরুরি, আবার একইসঙ্গে আইনি প্রক্রিয়া যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত না হয় তাও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ একটি দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করে ন্যায়বিচারের ওপর মানুষের আস্থার ওপর।
শেষ পর্যন্ত, এই স্বর্ণ উদ্ধার তদন্ত কীভাবে এগোবে, কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে, বা এর পরিণতি কী হবে—তা এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকবে। জনগণও অপেক্ষা করবে রাষ্ট্রীয় সংস্থার স্বচ্ছ ব্যাখ্যা, প্রমাণ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য। আর গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—যে কোনো তদন্ত বা বিচার যেন সত্য, ন্যায় এবং আইনি প্রক্রিয়ার ভিত্তিতেই সম্পন্ন হয়, কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা পক্ষপাত যেন এতে ছাপ ফেলে না যায়। এই প্রত্যাশাই দেশের নাগরিকদের মনে।
আপনার মতামত জানানঃ