ঢাকার নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে হঠাৎ বিশেষ বরাদ্দের বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে এক নতুন রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, আর তার আগেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ঢাকার ২৭৪টি ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে যে উন্নয়ন বরাদ্দ দিয়েছে, তার প্রেক্ষাপট এবং বণ্টনের ধরন বিশ্লেষণ করলে একটি বড় প্রশ্ন সামনে আসে: কেন বরাদ্দের প্রায় সবটুকুই ঢাকার মাত্র তিনটি সংসদীয় এলাকায় দেওয়া হলো? মোট ২০টি আসন থাকা সত্ত্বেও বাকি ১৭টি আসন প্রায় শূন্য বরাদ্দ পেয়েছে; আর যে তিনটি আসনে বরাদ্দ গেছে, তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বরাদ্দ এককভাবে ঢাকা-১০ আসনে দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি বাংলার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৭৪টির মধ্যে ২৭৩টি প্রতিষ্ঠানই ঢাকা-১০, ঢাকা-৯ এবং ঢাকা-১১ আসনে অবস্থিত। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ—১৪৫টি প্রতিষ্ঠান—ঢাকা-১০ আসনে পড়ে, যেখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বরাদ্দের পরিমাণ চার কোটি ৪৩ লাখ টাকা। মোট বরাদ্দ আট কোটি ২৯ লাখ টাকা হলে, তার অর্ধেকেরও বেশি শুধু এক আসনে দেওয়া হয়েছে। এই বরাদ্দের সময়কাল এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ভোটার এলাকা পরিবর্তন করে ঢাকা-১০ আসনে ভোটার হয়েছেন। ঠিক এরপরই তার মন্ত্রণালয় থেকে ওই একই আসনের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে একের পর এক বরাদ্দ দেওয়া হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি নির্বাচনের আগে ভোটারদের উদ্দেশে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের প্রচেষ্টা?
প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, তিনি জানেন না কারা এসব প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দের আবেদন করেছে। তার দাবি, সারা দেশেই বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, এবং ঢাকার তিনটি আসনকে আলাদা করে দেখার কোনো কারণ নেই। তবে তথ্য বিশ্লেষণ বলছে অন্য কথা—বরাদ্দের বণ্টন ঢাকার অন্য ১৭টি আসনের তুলনায় এই তিনটিতেই অস্বাভাবিকভাবে কেন্দ্রীভূত। তাছাড়া নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর এ ধরনের বরাদ্দ আর দেওয়া যায় না। ডিসেম্বরের শুরুতেই তফসিল ঘোষণার কথা, ঠিক তার আগে এত বড় বরাদ্দের ঘোষণা নৈতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বলেছেন, নির্বাচনের একেবারে পূর্বমুহূর্তে এ ধরনের বিশেষ বরাদ্দ “দৃষ্টিকটু” এবং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের ইঙ্গিত দেয়। তিনি মনে করেন, যে সময়ে সরকার বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, সে সময়ে বরাদ্দের এমন অস্বাভাবিক কেন্দ্রীকরণ উদ্বেগজনক। এর আগে সড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়নে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপদেষ্টার নিজ জেলা কুমিল্লার মুরাদনগরে ৪৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। ফলে একই ব্যক্তির নির্বাচনী এলাকা পরিবর্তন এবং একইসঙ্গে বরাদ্দের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি স্বভাবতই আরও বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ঢাকা-৯ এবং ঢাকা-১১ আসনেও যথাক্রমে সবুজবাগ-খিলগাঁও এবং বাড্ডা-রামপুরা এলাকার অধীনে ১২৮টি প্রতিষ্ঠানে তিন লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই দুই আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃবৃন্দ নাহিদ ইসলাম এবং তাসনিম জারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। গত বছরের আন্দোলনে যেসব নেতারা সক্রিয় ছিলেন, তাদেরই সংশ্লিষ্টতায় ঢাকার তিনটি আসনকে বরাদ্দের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে কি না—এ প্রশ্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা কমিটি ইতোমধ্যে অর্থ ছাড়ের কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
এডিপির আওতায় বরাদ্দ দেওয়া হলে সাধারণত তিন লাখ টাকার মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা হয়, যাতে টেন্ডার ছাড়াই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কমিটি কাজ পরিচালনা করতে পারে। এটি একদিকে দ্রুত কাজ সম্পন্নের সুযোগ তৈরি করলেও, অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে বরাদ্দ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়। এই কাঠামো বরাদ্দকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, এমন মন্তব্যও করেছেন বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, বিশেষ বরাদ্দ মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকে এবং তারা আবেদন বিবেচনা করে অর্থ ছাড় করেন। কিন্তু আবেদন আসা এবং অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে কি না—এ প্রশ্নটি অস্বীকার করা কঠিন।
পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের আগে উন্নয়ন বরাদ্দ বা বড় প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ বলে গণ্য হয়। কারণ এটি ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে, কিংবা নির্বাচনের সমতার নীতি লঙ্ঘন করতে পারে। বাংলাদেশেও এই নীতিগত প্রশ্ন এখন আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যখন দেখা যায় বরাদ্দগুলো কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে অস্বাভাবিক ঘনত্বে যাচ্ছে এবং সেই অঞ্চল থেকেই সরকারি পরামর্শকের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, “কেউ আবেদন না করলে বরাদ্দ দেওয়া যায় না।” কিন্তু বাস্তবে আবেদন কারা করেছে, তাদের প্রভাব কতটা, এবং বরাদ্দ অনুমোদনের ক্ষেত্রে কারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে—এসব বিষয় অস্পষ্ট। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে বরাদ্দ বিতরণ প্রক্রিয়ায় এখনো অস্বচ্ছতা রয়ে গেছে। দেশে যখন নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চলছে, তখন বরাদ্দ নিয়ে এমন বিতর্ক রাজনৈতিক উত্তাপ আরও বাড়াতে পারে।
সবশেষে প্রশ্ন থেকে যায়—ঢাকার তিনটি আসনে এভাবে বরাদ্দ কেন্দ্রীভূত হওয়ার নেপথ্যে আসলে কী উদ্দেশ্য কাজ করেছে? যদি সত্যিই সারা দেশে বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে অন্য আসনগুলোর বরাদ্দ কোথায়? বরাদ্দ বণ্টনে কি জনসংখ্যা, অবকাঠামো বা চাহিদার ভিত্তিতে কোনো যৌক্তিক পরিকল্পনা ছিল? নাকি নির্বাচনের আগে ভোটারদের প্রভাবিত করার রাজনৈতিক প্রয়াস ছিল এর পেছনে?
নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা এবং নির্বাচন-সংক্রান্ত ন্যায়সংগত পরিবেশকে কতটা প্রভাবিত করবে তা এখন দেখার বিষয়। তফসিল ঘোষণার আগেই যখন রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নামছে, তখন সরকারি বরাদ্দের এমন বিতর্ক ভবিষ্যতের নির্বাচনকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তবে সরকার যদি দ্রুত আরও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া ঘোষণা করে, বরাদ্দের প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করে এবং বণ্টনে সমতা নিশ্চিত করে, তবে আস্থার সংকট কিছুটা হলেও কমতে পারে। কিন্তু বর্তমান তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে নির্বাচনী পরিবেশের ন্যায়সংগততা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তোলে।
আপনার মতামত জানানঃ