বাংলাদেশের শিক্ষা খাত এখন এক জটিল বিশৃঙ্খলার মধ্যে আটকে আছে, যার মূল কেন্দ্র প্রশাসনিক নেতৃত্বহীনতা, শিক্ষাক্রম নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও দাবি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে কয়েক মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করলেও সম্প্রতি তাঁর অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার ফলে একসঙ্গে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য হয়ে যায়। পাঠ্যবই ছাপানোর এই মৌসুমে নেতৃত্বশূন্য একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করছে দেশের নতুন বছরের শুরুতে বই বিতরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শিক্ষা খাতের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন দীর্ঘ শূন্যতা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরেও মহাপরিচালকের পদ মাসখানেক ধরে খালি, যেখানে একজন কর্মকর্তা কেবল রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে কাজটি নিয়মিত হওয়া উচিত, সেটিই এখন অনিশ্চয়তার মাঝখানে পড়ে গেছে, ফলে প্রশাসনিক গতি ফিরছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণ–অভ্যুত্থানের পর মানুষ শিক্ষায় পরিবর্তন আশা করেছিল, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময় শিক্ষাকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাক্রম সংশোধন ও রূপরেখা তৈরির বিষয়েও একই রকম স্থবিরতা। গত তিন বছর ধরে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম চলতি বছর কিছু শ্রেণিতে চালুর কথা ছিল। কিন্তু জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর পুরো মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম বাতিল করে এক যুগ আগের ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম পুনর্বহাল করা হয়। শিক্ষাক্রম সাধারণত যুগোপযোগী রাখতে পাঁচ বছর পরপর সংশোধন করা হয়, কিন্তু এখন ২০২৫ সালেও পুরোনো কাঠামোয় ফেরত যাওয়ায় অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল হলেও তার বিকল্প কোনো পরিকল্পনা নেই, নেই নতুন রূপরেখা তৈরির কোনো কমিটি। নির্বাচন সামনে থাকায় নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগও কমে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে এটি শিক্ষার মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যা নতুন করে অযৌক্তিক প্রতিযোগিতা ও বৈষম্য তৈরি করবে বলে উদ্বেগ রয়েছে।
এদিকে দেশের শিক্ষক সমাজ আন্দোলনে ফুঁসছে। বেতন গ্রেড সমন্বয়সহ বিভিন্ন দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বেসরকারি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান, নন-এমপিও শিক্ষক—সবাই আন্দোলনে নেমেছেন একের পর এক। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা বেতন গ্রেড দশমে উন্নীত করার দাবিতে টানা তিন দিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন, যার ফলে অনেক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ থাকে। উপদেষ্টারা এই দাবি ‘অযৌক্তিক’ বললেও শিক্ষকদের ক্ষোভ থামেনি। অন্যদিকে নন-এমপিও শিক্ষকরা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার দাবিতে তিন সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছেন; পুলিশি বাধা, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহারের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও বাড়িভাড়া ও অন্যান্য ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন, পরে সরকার ধাপে ধাপে বাড়িভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও অসন্তোষ পুরোপুরি কমেনি।
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের আরেক বড় ভোগান্তি অবসর ও কল্যাণসুবিধা সংক্রান্ত। অর্থসংকটের কারণে প্রাপ্য সুবিধা পেতে তাদের মাসের পর মাস, কখনো দুই-তিন বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অবসরসুবিধা বোর্ড পুনর্গঠন হয়নি দীর্ঘদিন, দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পরিবর্তন হলেও কাজের অগ্রগতি নেই। চাকরির শেষ প্রান্তে এসেও নিজের প্রাপ্য সুবিধা না পাওয়া একটি গভীর মানসিক চাপ তৈরি করছে শিক্ষকদের মধ্যে। এমন পরিস্থিতি হতাশা বাড়াচ্ছে, আর এটি সামগ্রিক শিক্ষা কাঠামোর দুর্বলতা আরও স্পষ্ট করছে।
ঢাকার সাত কলেজের সমস্যা আরেকটি বড় সংকট। এই কলেজগুলোকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল, আবার এ বছর তা বাতিল করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কাঠামো চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নামে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ায় আইনি প্রশ্ন উঠেছে। আইন পাস হওয়ার আগেই ভর্তি কার্যক্রম শুরু করাকে শিক্ষকেরা বেআইনি বলে উল্লেখ করেছেন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন হচ্ছে, ক্লাস বন্ধ রয়েছে, শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছেন—সব মিলিয়ে একটি অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও দ্বিধায় আছে কোন কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় হবে তা নিয়ে। অধ্যাদেশসহ পুরো প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সংকট আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
মাঝে শিক্ষা খাতে কোনো কমিশন গঠন না করা নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বিভিন্ন খাতে ১১টি কমিশন গঠন হলেও শিক্ষা খাত উপেক্ষিত থাকে। পরবর্তীতে গত মাসে মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হলেও অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কমিটির সুপারিশের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয় না। অধ্যাপক মনজুর আহমদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কাজ শুরু করলেও তারা আশঙ্কা করছেন, যদি সুপারিশ বাস্তবায়ন না হয়, তা হবে বড় ধরনের আশাভঙ্গ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক পরিচয় বা সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ-বদলি না করে যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। একই সঙ্গে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সম্মানী বাড়ানো জরুরি, যাতে তারা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার কাজে মনোযোগ দিতে পারেন।
এই বহুমুখী সংকটের পেছনে মূল সমস্যা হলো শিক্ষাকে অগ্রাধিকার না দেওয়ার প্রবণতা। শিক্ষা খাতের উন্নয়ন কোনো সরকারের জন্যই এক দিনে সম্ভব নয়, বরং এটি ধারাবাহিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে উল্টো দিক—একদিকে গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য, অন্যদিকে শিক্ষাক্রম বাতিল হয়ে পুরোনো কাঠামোতে ফিরে যাওয়া, শিক্ষক আন্দোলনে ক্লাস বন্ধ, প্রশাসনিক স্তরে দুর্বলতা, বৃত্তি পরীক্ষা পুনরায় চালু করা, আর বড় কলেজগুলোতে জটিল সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত ঝুঁকিতে ফেলা—সব মিলিয়ে একটি অস্থির, অনিশ্চিত এবং দিকহীনতার চিত্র সামনে আসছে।
একটি দেশের উন্নয়ন মূলত নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্থার মানের ওপর। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা খাত এমন এক অবস্থায় রয়েছে যেখানে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, নীতিনির্ধারণী অস্থিরতা এবং নেতৃত্বহীনতা একসঙ্গে জড়ো হয়ে গোটা ক্ষেত্রটিকে এলোমেলো করে তুলেছে। শিক্ষকদের নানা দাবি, আন্দোলন ও ক্ষোভও দেখাচ্ছে যে গভীরে অনেক সমস্যা চাপা পড়ে আছে। শিক্ষাক্রম নিয়ে দোলাচল, বই মুদ্রণে অনিশ্চয়তা, অবসর সুবিধার জটিলতা, সাত কলেজকে ঘিরে জট—এসব একটি স্থবির শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিফলন।
এই অবস্থায় প্রয়োজন দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ। নির্বাচনের আগে বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হলেও অন্তত প্রশাসনিক পদের শূন্যতা পূরণ, শিক্ষাক্রমের ভবিষ্যত নিয়ে একটি স্পষ্ট ঘোষণা, শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিগুলোর সমাধান এবং কলেজ সংকটের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষা খাতকে যদি সত্যিই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবের বাইরে রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষাবিদদের মতে, যোগ্য ব্যক্তিদের নেতৃত্ব, পর্যাপ্ত বরাদ্দ, যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং শিক্ষকদের প্রতি সম্মানই পারে এই এলোমেলো অবস্থা কাটাতে।
যদি এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে এর প্রভাব পড়বে পুরো প্রজন্মের ওপর। শিক্ষা শুধু পাঠ্যবই বা পরীক্ষার বিষয় নয়, এটি একটি দেশের চিন্তা-চেতনা, উন্নয়ন ও মানবসম্পদের ভিত্তি। তাই শিক্ষার এই অচলাবস্থা যত দ্রুত কাটানো যাবে, ততই দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।
আপনার মতামত জানানঃ