বাংলাদেশে ২০২৫ সালের উচ্চ মাধ্যমিক বা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেশজুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ, গত ২০ বছরের মধ্যে এটিই সবচেয়ে খারাপ ফলাফল হিসেবে ধরা হচ্ছে। এবছর সারাদেশে গড় পাশের হার হয়েছে মাত্র ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রায় ১২ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে পাঁচ লাখেরও বেশি অকৃতকার্য হয়েছে। এর আগে ২০০৫ সালে গড় পাশের হার ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ, এরপর আর কখনও তা এত নিচে নামেনি। শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, অভিভাবক—সবাই ভাবছেন, এমন ফলাফল কেন হলো? কোথায় সমস্যা হচ্ছে? শিক্ষা ব্যবস্থার এই ‘বিপর্যয়’ আসলে কি খারাপ ফলাফল, নাকি এটি বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন?
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাশের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর কয়েক বছর ধরে গড় পাশের হার ছিল ৮০ শতাংশের ওপরে। অনেক সময় শতভাগ অটোপাশের ব্যবস্থাও চালু হয়েছিল। কিন্তু এবছরের ফলাফল সেই ধারায় এক বড় ধাক্কা দিয়েছে। গড় পাশের হার কমে এসেছে হঠাৎ করেই, আর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অর্ধেকে নেমে গেছে। গত বছর যেখানে দেড় লাখের বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিল, এবছর সেই সংখ্যা মাত্র ৬৯ হাজার ৯৭ জন।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই পরিবর্তনের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, পরীক্ষায় মূল্যায়নের নিয়মে এবার কড়াকড়ি ছিল আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। অনেক বোর্ডে নির্দেশ ছিল—শিক্ষার্থীরা খাতায় যা লিখবে, কেবল তার ভিত্তিতেই নম্বর দেওয়া হবে। অতীতে যেভাবে গ্রেস মার্ক বা ‘সহানুভূতি নম্বর’ দেওয়া হতো, এবছর তা দেওয়া হয়নি। ফলে অনেক শিক্ষার্থী পাস নম্বরের কাছাকাছি থেকেও ফেল করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা ড. সি. আর. আবরার বলেছেন, এখন থেকে আর বাড়িয়ে নম্বর দেওয়া হবে না, যে যেমন লিখবে সে তেমন ফল পাবে। তাঁর মতে, “আমরা এতদিন সংখ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম। পাশের হারকেই সাফল্যের প্রতীক বানিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এখন সেই সংস্কৃতি বদলানো দরকার।”
এবারের ফলাফলের পেছনে শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরের দীর্ঘদিনের গলদও অনেকাংশে দায়ী। দেশের অনেক কলেজে শিক্ষাদান কার্যক্রম ঠিকভাবে হয় না, শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নেন না, অনেক জায়গায় উপযুক্ত শিক্ষকই নেই। ঢাকার বাইরে অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট কোচিংয়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ফলে প্রকৃত শেখার চেয়ে পরীক্ষার কৌশল মুখস্থ করাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলেছেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা কতটা হচ্ছে, শিক্ষকরা আসলে ক্লাসে পড়ান কি না, এগুলোও দেখতে হবে। শুধু রাজনৈতিক কারণ খোঁজা যথেষ্ট নয়।”
তবে রাজনীতির প্রভাব অস্বীকার করার উপায়ও নেই। গত এক যুগে বহু শিক্ষাবিদই অভিযোগ করেছেন, সরকারগুলো রাজনৈতিকভাবে ভালো ফলাফল দেখানোর প্রবণতা তৈরি করেছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের খাতা বাস্তবতার চেয়ে বেশি নম্বর দিয়ে গড় পাশের হার বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এভাবে ‘সাফল্যের’ ভান তৈরি হলেও শিক্ষার মান ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, “এতোদিন যে ফলাফল দেখানো হতো, তা রাজনৈতিক ফলাফল ছিল। এবারের ফলাফল হয়তো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত চিত্রই তুলে ধরেছে।”
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিক্ষাক্রম বা কারিকুলামে বারবার পরিবর্তন আনা। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেকবার পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবার নতুন পাঠ্যপদ্ধতি, নতুন মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা হলেও তা ঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়নি। শিক্ষকরা নতুন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত নন, শিক্ষার্থীরাও বিভ্রান্ত হয়েছে। এতে করে শিক্ষার ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়েছে। কুমিল্লার কলেজ শিক্ষক তবারক উল্লাহ মনে করেন, এই ক্রমাগত পরিবর্তন, সামাজিক অস্থিরতা এবং দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতিই ফলাফল খারাপ হওয়ার বড় কারণ।
এছাড়া প্রযুক্তি নির্ভর নতুন প্রজন্মের পড়াশোনার অভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেক শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন, ইউটিউব বা এআই-নির্ভর সংক্ষিপ্ত নোটের ওপর নির্ভর করছে। শিক্ষক আশিষ কুমার বিশ্বাস মনে করেন, এর ফলে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ও লেখার ক্ষমতা কমে গেছে। তারা গভীরভাবে কোনো বিষয় শিখতে চায় না, বরং দ্রুত পরীক্ষায় পাস করার টোটকা খোঁজে। পরীক্ষায় যখন প্রশ্ন কঠিন হয় বা নম্বর কড়াকড়িভাবে দেওয়া হয়, তখন তারা ব্যর্থ হয়।
বোর্ডভিত্তিক ফলাফলেও বড় পার্থক্য দেখা গেছে। ঢাকা বোর্ডে পাশের হার ছিল সবচেয়ে বেশি—৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ, আর কুমিল্লা বোর্ডে সবচেয়ে কম—৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। দেশের ২০২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। এসব পরিসংখ্যান দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য ও মানের পার্থক্য স্পষ্ট করে দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি আসলেই ‘ফলাফলের বিপর্যয়’, নাকি বহুদিনের বাস্তব চিত্র সামনে এসেছে? শিক্ষাবিদদের একাংশ মনে করছেন, এতদিন যে ভালো ফলাফল দেখানো হচ্ছিল, তা ছিল কৃত্রিম। এবারের ফলাফল বাস্তব অবস্থা প্রকাশ করেছে। আবার অনেকে বলছেন, যদি শিক্ষার্থীরা এভাবে ফেল করতে থাকে, তবে তা দেশের ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক। কারণ, এটি প্রমাণ করে যে শিক্ষার ভিত্তি—বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর—দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ড. সি. আর. আবরারের ভাষায়, “দেশের শিক্ষার সংকট শুরু হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। সেই ঘাটতি জমা হয়ে উচ্চমাধ্যমিকে এসে এমন ফলাফল দিচ্ছে। আমরা এতদিন শেখার ঘাটতি আড়াল করেছি, এখন সেটি চোখে পড়ছে।”
এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় এখন আমূল সংস্কার দরকার। শুধু ফলাফলের হার বা জিপিএ-৫ নয়, শিক্ষার্থীরা আসলে কী শিখছে, তাদের মনোভাব, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা—এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। পাস করাকে লক্ষ্য না করে শেখাকে লক্ষ্য বানাতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে সার্টিফিকেট অর্জনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সবাই চায় পাস করতে, কিন্তু শেখার আনন্দ বা জ্ঞান অর্জনের মূল্যায়ন হারিয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে সেই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে রাজনীতি ও সংখ্যার হিসাব থেকে বের করে এনে বাস্তব শেখার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
এবছরের এইচএসসি ফলাফল তাই একদিকে হতাশার, অন্যদিকে সতর্কবার্তা। এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—শিক্ষার ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে। এখনই যদি পরিবর্তন না আনা যায়, তবে ভবিষ্যতে এই সংকট আরও গভীর হবে। তাই এই ফলাফলকে কেবল ‘খারাপ খবর’ হিসেবে না দেখে, একে বাস্তবতার আয়না হিসেবে দেখা দরকার। কারণ, এই আয়নায় যা দেখা যাচ্ছে, সেটিই হয়তো বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত রূপ।
আপনার মতামত জানানঃ