বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের যে ভয়াবহ চিত্র সেপ্টেম্বর শেষে সামনে এসেছে, তা শুধু আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকেও বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে দেখা যাচ্ছে—সব ব্যাংক মিলে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকা ঋণ দেওয়া হলে তার প্রায় ৩৬ টাকাই আর ফেরত আসছে না। এমন একটি পরিস্থিতি কোনো দেশের জন্যই বিপজ্জনক; আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি অর্থনীতির গভীরে জমে থাকা দীর্ঘদিনের অসুস্থতার একটি স্পষ্ট প্রতিফলন।
এ অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে গত বছরের ডিসেম্বরের চিত্র ছিল কিছুটা কম উদ্বেগজনক, যদিও তখনও পরিস্থিতি ভালো ছিল না। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। মাত্র ৯ মাসে এই অঙ্ক প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটিতে—অর্থাৎ বৃদ্ধি ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাতের কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই ধরনের লাফিয়ে বাড়া সংখ্যাই যথেষ্ট চমকে দেওয়ার জন্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত সরকার আমলে বিভিন্ন নামে-বেনামে বিপুল অর্থ ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণের নামে যে অর্থ লোপাট করা হয়েছিল, সেটির বড় একটি অংশ এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ঋণ খেলাপির নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছে। সেজন্য বেশ কিছু ঋণ, যা আগে নবায়ন করে বা কাগজে-কলমে সাদা রাখা হতো, এখন নন-পারফর্মিং হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। এতে প্রকৃত খেলাপির চিত্র আরও স্পষ্ট হচ্ছে। বহু ঋণ নবায়নের আড়ালে বছরের পর বছর ফেরত আসেনি। অনিয়মের মাধ্যমে যেসব ঋণ প্রদান করা হয়েছিল, সেগুলোর একটি বড় অংশ এখন আদায়যোগ্য নয় বলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, এবং উদ্বেগও বাড়ছে বহুগুণে।
এই খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি যে নতুন একটি সঙ্কট তৈরি করেছে, তা বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হয়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো যে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, তার মধ্যে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা খেলাপি—এটি যে কোনো দেশের আর্থিক খাতের জন্য অস্বাভাবিক উচ্চহার। এক বছরে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। এই সময়ে কোনো বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেনি, কোনো বৈশ্বিক সংকট নেই, কোনো মহামারি নেই—তবুও এভাবে খেলাপির বৃদ্ধি দেখায় যে সমস্যার根ধরে রয়েছে গভীর অনিয়ম, দুর্বল নজরদারি এবং বহুবছরের ভুল নীতি।
ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনের আরও তথ্য আরও স্পষ্টভাবে সমস্যাটি তুলে ধরে। গত মার্চে নন-পারফর্মিং ঋণের হার ছিল ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ, যা এক বছর আগে ছিল মাত্র ১২ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণের হার দ্বিগুণ হয়েছে। জুন শেষে মোট ঋণ-অগ্রিম দাঁড়িয়েছিল ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা খেলাপি। ত্রৈমাসিক হিসাব অনুযায়ী খেলাপির হার ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ব্যাংকিং খাতের সুস্থতার জন্য বড় হুমকি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ১৬ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংকিং খাতে যে অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, দুর্বল তদারকি, ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া, ঋণের টাকা বিদেশে পাচার—এসব কারণে খেলাপির ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এখন সরকার পরিবর্তনের পর যখন হিসাব-নিকাশ স্পষ্ট হচ্ছে, তখন একে একে ঋণগুলো নন-পারফর্মিং হয়ে পড়ছে। ফলে খেলাপি ঋণের পাহাড় এখন দৃশ্যমান।
এই অবস্থার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৯ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪১ দশমিক ১ শতাংশ—এটি ছিল এক ধরনের রেকর্ড। এরপর নানা সংস্কার, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপ, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় কিছু পরিবর্তনের কারণে ২০১১ সালে এটি কমে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ১ শতাংশে। কিন্তু সেখান থেকেই আবার ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা শুরু হয়। এখনকার পরিস্থিতি সেই পুরোনো সংকটকেই নতুনভাবে সামনে এনেছে।
এমন একটি দেশে যেখানে ব্যাংক খাত শিল্পোন্নয়ন, কর্মসংস্থান, ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের মূল জ্বালানি, সেখানেই যদি ঋণ ফেরত না আসে, তাহলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যাংক অকার্যকর হয়ে যায়, ব্যবসায়ীরা ঋণ পায় না, কর্মসংস্থান কমে যায়, নতুন শিল্প গড়ে ওঠে না, ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলো তাদের ক্ষতি পূরণ করতে আমানতের ওপর কম সুদ দেয় এবং ঋণের ওপর বেশি সুদ চাপায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হয় উদ্যোক্তা শ্রেণি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের কৃত্রিম স্থিতিশীলতার ফল। ঋণ নিয়ে ব্যবসা না করে অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে, ভুয়া প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ব্যাংক লুট করা হয়েছে, একের পর এক ঋণ নবায়ন করা হয়েছে, বড় খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে খেলাপির সংস্কৃতি গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজকের এই বিপর্যয় সেই সংস্কৃতিরই দুঃসহ ফল।
সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাত এখন একটি কঠিন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। এই সঙ্কট কাটাতে হলে প্রয়োজন শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কঠোর নজরদারি, সত্যিকারের ঋণ পুনর্গঠন, বড় খেলাপিদের বিচারের মুখোমুখি করা, এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শুদ্ধি অভিযান। খেলাপি ঋণ কমানো শুধু অর্থনীতির স্বার্থেই নয়, রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্যও জরুরি।
এমন পরিস্থিতিতে সময়ক্ষেপন বা রাজনৈতিক সমঝোতার জায়গা নেই। ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করা মানেই দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করা। আর অর্থনীতিকে রক্ষা করা মানে দেশের সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করা। তাই এখনই প্রয়োজন দৃঢ় পদক্ষেপ—নয়তো খেলাপি ঋণের এই পাহাড় আগামী দিনে পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকেই ধসের মুখে ফেলে দিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ