
বাংলাদেশে স্নাতকোত্তর বেকারত্বের সর্বশেষ চিত্র সমাজ ও অর্থনীতির একটি জটিল সংকটকে সামনে এনেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ অনুযায়ী, প্রায় ৯ লাখ স্নাতক তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানহীন অবস্থায় রয়েছে। এই হার ১৩.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার সকল স্তরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সংখ্যায় কিছুটা কমলেও হার বৃদ্ধিই বোঝাচ্ছে যে সমস্যা ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে।
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হওয়ার পেছনে একাধিক কাঠামোগত ও নীতিগত কারণ রয়েছে। সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া সীমিত ও অনিয়মিত, ফলে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক তরুণ প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও কেবলমাত্র অল্প কয়েকজনই সুযোগ পাচ্ছে। বেসরকারি খাতও প্রত্যাশিত হারে সম্প্রসারিত হয়নি। উদ্যোক্তা সৃষ্টির পরিবেশ অনুকূল নয়, কর্পোরেট সেক্টরে নিয়োগ কার্যক্রমও স্থবির হয়ে আছে। ফলে শিক্ষিত তরুণদের দক্ষতা থাকলেও তারা শ্রমবাজারে নিজস্ব জায়গা তৈরি করতে পারছে না।
এদিকে নারী স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হারও উদ্বেগজনক। প্রায় ২০ শতাংশ নারী স্নাতক বেকার অবস্থায় রয়েছে। এর পেছনে সমাজে নারীর অংশগ্রহণ সীমিত রাখা, পরিবার ও কর্মক্ষেত্রের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং নিরাপত্তাহীনতা বড় ভূমিকা রাখছে। একদিকে শিক্ষায় মেয়েদের সাফল্যের হার বাড়ছে, অন্যদিকে তারা শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারছে না—এটি সামাজিক ভারসাম্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
অন্যদিকে নিম্নমাধ্যমিকের নিচে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যেও বেকারত্ব বেড়েছে। ২০২৪ সালে এই স্তরের বেকার যুবকের সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। এর কারণও বহুমাত্রিক—প্রযুক্তি ও দক্ষতার অভাব, অদক্ষ শ্রমের বাজার সংকোচন এবং বিদেশি শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা। ফলে শ্রমজীবী তরুণদের জন্যও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন যথার্থভাবেই বলেছেন যে কর্মসংস্থানের এই দুরবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ও বিনিয়োগের অভাবের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। দেশে নতুন শিল্প ও উদ্যোক্তা তৈরির পর্যাপ্ত পরিবেশ নেই। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, দুর্নীতি, জ্বালানি সংকট, উচ্চ ঋণের সুদহার এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে, যা মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করলেও বিনিয়োগের গতি কমিয়ে দিয়েছে।
অর্থনীতির সমগ্র চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা হলেও ধরে রাখা গেছে। তবে এই প্রবৃদ্ধি বিভ্রান্তিকর, কারণ প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি—বিনিয়োগ—বৃদ্ধি পায়নি। বিদেশি বিনিয়োগও প্রত্যাশিত মাত্রায় আসেনি। নতুন শিল্প স্থাপন বা বিদ্যমান শিল্পে সম্প্রসারণ ঘটেনি। উপরন্তু, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও শ্রমবাজারের অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশের বেকার তরুণদের এই ক্রমবর্ধমান সংখ্যা শুধু একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়; এটি সামাজিক ও মানসিক সংকটও বটে। হতাশা, মাদকাসক্তি, অপরাধ প্রবণতা এমনকি অভিবাসনের অবৈধ পথ বেছে নেওয়ার প্রবণতাও এর সঙ্গে যুক্ত। দক্ষ শিক্ষিত তরুণরা যখন নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না, তখন তারা দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না। এর ফলে মেধাপাচার বাড়ছে এবং রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
সরকারের উচিত কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। এজন্য কেবল সরকারি চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি নয়, বরং শিল্পনীতি, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ, এবং তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর কর্মক্ষেত্রের প্রসার ঘটাতে হবে। বিশেষ করে ডিজিটাল অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং, স্টার্টআপ এবং উদ্ভাবনী খাতগুলোতে বড় ধরনের বিনিয়োগ আনতে হবে। নারীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে নিরাপদ পরিবেশ, মাতৃত্বকালীন সাপোর্ট এবং কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ জরুরি।
শিক্ষা ব্যবস্থাকেও শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যারা বের হচ্ছে তাদের অনেকের দক্ষতা বাস্তব বাজারের চাহিদার সঙ্গে মেলে না। তাই পাঠ্যক্রম পুনর্গঠন, ইন্টার্নশিপের সুযোগ বৃদ্ধি, এবং শিল্প-শিক্ষা সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। কেবল সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করে গেলে সমস্যা আরও জটিল হবে।
সর্বোপরি বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা একটি নিম্নস্তরের ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে জিডিপি কিছুটা বাড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে নামছে, কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এ অবস্থায় দেশের উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া বিকল্প নেই। কর্মসংস্থান সৃষ্টি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার সঙ্গেও জড়িত।
আপনার মতামত জানানঃ