বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে গভীর রাতের ঘটনাগুলো সবসময়ই জনমনে নানা প্রশ্ন তোলে। রাত ১২টার দিকে কারও বাড়িতে হঠাৎ দরজায় কড়া, পরিচয়ে ‘ডিবি পুলিশ’, এবং কোনও স্পষ্ট অভিযোগ ছাড়াই কাউকে গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া—এ দৃশ্য অতীতে বহুবার আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সময় পাল্টালেও, মানুষ এখনো এই দৃশ্যকে দেখে ঘোর সন্দেহের চোখে। সম্প্রতি সাংবাদিক ও মিডিয়া পরামর্শক মিজানুর রহমান সোহেল এবং ব্যবসায়ী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ পিয়াসকে গভীর রাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা আবারও সেই পুরোনো আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। ঘটনা যেমনভাবে ঘটেছে, তেমনি তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষের ব্যাখ্যা, সামাজিক মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাব—সব মিলিয়ে এটি একটি বড় বিতর্কের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে।
মিজানুর রহমান সোহেলের বর্ণনা অনুসারে, ঘটনাটি ঘটে মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়ে। বাড়িতে থাকা অবস্থায় কয়েকজন ব্যক্তি ‘ডিবি পুলিশ’ পরিচয়ে এসে বলেন, তাদের প্রধান তার সঙ্গে কথা বলতে চান। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে, আবার বাড়িতেও পৌঁছে দেওয়া হবে—এ আশ্বাস দিয়ে তাকে গাড়িতে তোলা হয়। সোহেলের দাবি, তাঁকে জানানো হয়নি তিনি কোন অভিযোগের মুখে, কিংবা কেন তাকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। তাঁর ভাষায়, “আমি জানতামই না, কেন আমাকে নেওয়া হচ্ছে। শুধু বলা হলো, কথা বলবেন।” শুধু তাকেই নয়, বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশ বা এমবিসিবি নামের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ পিয়াসকেও একই রাতে তুলে নেওয়া হয় মিরপুরের বাসা থেকে। পিয়াসের স্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, রাত ১টার দিকে তার স্বামীকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
এই ঘটনাকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই নানা ব্যাখ্যা সামনে আসতে শুরু করে। একদিকে সাংবাদিক সোহেল বলছেন, এটি ছিল মোবাইল ব্যবসায়ী সংগঠনটির একটি সংবাদ সম্মেলন ঠেকানোর প্রচেষ্টা। এই সংগঠনটি সরকারের এনইআইআর (ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার) উদ্যোগের বিরুদ্ধে কিছু সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রস্তুত করছিল। সোহেলের ভাষ্যমতে, এনইআইআর কার্যকর হলে ২৫ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মাত্র নয়জন ব্যবসায়ী বিশাল সুবিধা পাবে। এই প্রকল্পকে ‘ডিজিটাল নজরদারি’, ‘মোনোপলি তৈরি’, এবং ‘গোপন বিদেশি ফোন বাজার নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র’ বলেও কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন। সোহেল দাবি করেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান এমবিসিবির এই সংবাদ সম্মেলনের মিডিয়া পরিচালনার দায়িত্বে থাকায় তাঁকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
অন্যদিকে গোয়েন্দা পুলিশের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। ডিবি প্রধান শফিকুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে জানান, বিষয়টি ছিল “তথ্যগত ভুল বোঝাবুঝি”-র ফল। তিনি বলেন, এমবিসিবির সংবাদ সম্মেলনের বিজ্ঞপ্তিতে সভাপতির নামের সঙ্গে সোহেলের প্রতিষ্ঠানের নাম ও নম্বর ছিল। তাই সংগঠনটি সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে ভুলবশত তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। তার দাবি, সোহেলকে কোনো রকমের তদন্ত বা অভিযোগ ছাড়াই শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ামাত্রই সকালে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও সামাজিক মাধ্যমের আলোচনায় এই ব্যাখ্যাকে খুব বেশি মানুষ বিশ্বাস করতে পারছেন না।
কারণ প্রশ্ন উঠছে—মধ্যরাতে কাউকে ‘ভুল করে’ নিয়ে যাওয়া সম্ভব কি? ভুল হলে কেন কর্তারা দিনের বেলায় স্বাভাবিকভাবে যোগাযোগ করলেন না? বিশেষ করে এমন এক সময় যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সংবেদনশীল, তখন রাতের অন্ধকারে তুলে নেওয়ার ঘটনা মানুষের মনে পুরোনো ক্ষত খুলে দেয়। অতীতে বহু ব্যক্তি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, ভিন্নমত দমনে, কিংবা প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হিসেবে গভীর রাতে নিখোঁজ বা আটক হয়েছিলেন। ফলে নতুন সরকারের অধীনে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি মানুষ স্বাভাবিকভাবে দেখতে প্রস্তুত নয়।
এই ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের নাম। তাঁকে সরাসরি অভিযুক্ত না করলেও সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ উঠেছে যে তাঁর ইশারাতেই এই গ্রেপ্তারি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। মোবাইল ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা পর্যন্ত তাঁকে বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তাঁরা বলছেন, এনইআইআর প্রকল্পের মাধ্যমে স্মার্টফোন আমদানি ও বিক্রিতে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা চলছে এবং এই প্রকল্পে তৈয়্যবের ঘনিষ্ঠ একজন ব্যবসায়ী লাভবান হবেন।
তবে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর বক্তব্য, এটি সম্পূর্ণ একটি “স্বার্থান্বেষী মহলের অসত্য প্রচারণা।” তিনি বলেন, এনইআইআর অবৈধ মোবাইল আমদানি ও চোরাচালান রোধে একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত উদ্যোগ এবং এর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই। বরং তিনি অভিযোগ করেন, কিছু অবৈধ আমদানিকারক চক্র গণবিক্ষোভ সৃষ্টি করতে নতুন সংগঠন বানিয়ে এনইআইআর বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, মিডিয়া পরামর্শক সোহেল কীভাবে সংগঠনের ‘সভাপতি’ পরিচয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারেন। তৈয়্যবের বক্তব্য অনুযায়ী, সংগঠনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত নয়, ফলে এর ব্যাকগ্রাউন্ডও সন্দেহজনক।
ঘটনার পর আরও বড় প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ব্যবসায়ী মহলে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পিয়াস এখনো হেফাজতে রয়েছেন—এমন তথ্য প্রকাশিত হতেই বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশ সারাদেশে মোবাইল ফোনের দোকান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। তারা হুঁশিয়ারি দেয়, পিয়াসকে মুক্তি না দিলে সারাদেশে কঠোর আন্দোলন হবে। এই ঘোষণার ফলে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে মোবাইল ফোন ব্যবসা হঠাৎ স্থবির হয়ে পড়ে। সাধারণ ভোক্তারাও বিপাকে পড়েন, কারণ অনেক দোকানদার ক্ষোভে shutter নামিয়ে দেন।
এই সবকিছুর মাঝেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বিবিসিকে বলেন, অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা বা জিজ্ঞাসাবাদ করা স্বাভাবিক, কিন্তু “গভীর রাতে বাসায় গিয়ে কাউকে তুলে নেওয়া” কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাঁর মতে, এটি মানুষের নিরাপত্তাবোধকে ধ্বংস করে। তিনি বলেন, অতীতে যে ধরনের গুম, অপহরণ, রাতের বেলায় তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি ছিল, সেই অন্ধকার সময়ের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কাই এখন মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি করছে।
সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনা মানুষের রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বাসকে দুর্বল করে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জনগণ আশা করেছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে পরিবর্তন আসবে, জবাবদিহিতার নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে কাউকে “ভুল করে” তুলে নেওয়া সেই আস্থাকে ভঙ্গুর করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশ্ন উঠছে—এ ধরনের ‘ভুল’ কি সত্যিই ভুল, নাকি এটি সিদ্ধান্তহীন প্রশাসনিক চর্চার অংশ?
এনইআইআর প্রকল্প নিয়ে বিতর্কও কম নয়। কেউ এটিকে ফোন বাজারে স্বচ্ছতা আনতে প্রয়োজনীয় মনে করছেন, কেউ বলছেন এটি ডিজিটাল নজরদারি বাড়াবে, আবার কেউ বলছেন এটি বিদেশি হ্যান্ডসেট মার্কেটে বড় ব্যবসায়ীদের পক্ষে একটি চক্রান্ত। তাই এই ঘটনাকে অনেকে দেখছেন বৃহত্তর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের লড়াই হিসেবে।
সব মিলিয়ে, সাংবাদিক এবং ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাকে গভীর রাতে তুলে নেওয়ার এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদ নয়; এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, বাজার নিয়ন্ত্রণ, প্রযুক্তি নীতি, এবং নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক কঠিন বাস্তবতা। নতুন সরকারের পরিবর্তনের বার্তার সঙ্গে এ ঘটনার অস্বস্তিকর বৈপরীত্য মানুষকে ভাবাচ্ছে—পরিবর্তন কি সত্যিই এসেছে, নাকি পুরোনো পদ্ধতিই আবার নতুন রূপে ফিরে আসছে?
এই সন্দেহ, বিতর্ক এবং অস্পষ্টতার মাঝে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকছে দুইটি শব্দ—“ভুল বোঝাবুঝি”—যা দিয়ে গোয়েন্দা বিভাগ ঘটনাটি ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু জনগণ মনে করছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগে ‘ভুল’ শব্দটি কখনোই হালকা নয়, বিশেষ করে তা নাগরিকের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলে। বাংলাদেশে কবে সত্যিই প্রশাসনিক সংস্কারে স্থায়ী পরিবর্তন আসবে—এ প্রশ্ন তাই আবারও নতুন করে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ