চলুন প্রথমে একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। খুব বেশি আগের না। এই মার্চের ১২ তারিখের। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের চিত্র। স্ট্রেচারে পরে আছে জাকির হোসেন মিলন নামের এক ব্যক্তির মরদেহ। পাশেই তার স্বজনদের আহাজারি আর অভিযোগ। জাকির হোসেন মিলন ছিলেন তেজগাঁও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মানব-বন্ধনে অংশ নিতে প্রেসক্লাবে সামনে গিয়েছিলেন মার্চের ৬ তারিখে।
সেখান থেকেই পুলিশ গ্রেফতার করে তাকে। এর পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের রিমান্ডে ছিলেন তিন দিন। জাকির হোসেনের চাচা মো: ওয়ালিউল্লাহ বলছিলেন, রিমান্ডে নেয়ার পর ১১ই মার্চ প্রথম যেদিন তিনি জাকির হোসেনকে দেখেন সেদিনের কথা।। তিনি বলছিলেন ” প্রিজন ভ্যানে যখন উঠালো তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘বাবা মিলন তুমি কেমন আছো? সে বললো চাচা আমার শরীরটা ভালো না, আমি মনে হয় বাঁচবো না-সে কাঁদলো এই কথা বলে। আমার চোখেও পানি কিন্তু আমি বাসায় যেয়ে কাউকে বলিনি কারণ সবাই ভেঙ্গে পরবে তাই।”
পরদিন সকালে জাকির হোসেনের মৃত্যুর খবর পান ওয়ালিউল্লাহ । তিনি বলছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে যেয়ে তিনি দেখেন হোসেনের মরদেহ পড়ে আছে। শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন। তিনি জোর দিয়ে অভিযোগ করছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রিমান্ডে থাকার সময় মৃত্যু হয়েছে মি: হোসেনের।মো: ওয়ালিউল্লাহ বলছিলেন মরদেহের কোন ময়নাতদন্ত করা হয় নি।
তিনি বলছিলেন “আমাদের পিছনে ডিবির লোক, পুলিশের লোক, আমরা তো ময়না তদন্ত করতে পারিনি। কোন রকম লাশ বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের, আমি চাচা হিসেবে সাইন করেছি। এরপর যখন মিলনের জানাজা হয় সেখানে অনেক পুলিশ এবং সাদা পোশাকে ডিবির লোক ছিল। তাই ভয়ে অনেকেই জানাজায় আসেনি।”
বেড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু
এটাই বাংলাদেশের অলিখিত চিত্র। গত জুনেও মাসে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতের পাশাপাশি কারা হেফাজতে আগের মাসের তুলনায় মৃত্যু বেড়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে এ হিসাব দিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)।
গতকাল শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ হিসাব দিয়ে এমএসএফ বলেছে, দেশে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার ও পুলিশি বলপ্রয়োগের ঘটনা অব্যাহত আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার রুদ্ধ। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়তে থাকায় গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংগঠনটি।
দেশের ১৮টির বেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও নিজেদের সংগৃহীত তথ্যের বরাতে এমএসএফ জানিয়েছে, গত মাসে কারা হেফাজতে ১৬ জন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগের মাসে এ সংখ্যা ছিল ১১।
এমএসএফের প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, জুনে সীমান্তে হতাহতের ঘটনাও বেড়েছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন তিনজন। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়েছেন পাঁচজন।
দেশে ধারাবাহিকভাবে ধর্ষণসহ নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে এমএসএফ। সংগঠনটি বলেছে, অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধারের ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে। কমছে না গণপিটুনির মতো ঘটনাও।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেওয়ার কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেছে এমএসএফ। এর মধ্যে রাজবাড়ী থেকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্য পরিচয়ে গত ৬ জুন সিদ্দিক মিজি সোহেল (৫০) নামের এক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করার পরও এখনো তাঁর সন্ধান মেলেনি। তবে সোহেল নামের ওই ব্যবসায়ীকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করছেন রাজবাড়ী থানার উপপরিদর্শক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কারা হেফাজতে মৃত্যু অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতন, বেআইনি তৎপরতা ও পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২৬০ জন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর হেফাজতে মারা গেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০১৬ সালে এক বছরেই মারা গেছেন ৭৮ জন। থেমে নেই এখনও।
মে মাসে ১১ জনের মৃত্যু
কারা হেফাজতে গত মে মাসে দেশে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এপ্রিলে এ সংখ্যা ছিল ১৬। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে এমএসএফ।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী মে মাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে সাত হাজতি ও চার কয়েদির মৃত্যু হয়েছে।
এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, তাদের পরিচয়ে অপহরণ, গায়েবি মামলা, গ্রেপ্তার, রিমান্ডে নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মতামত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনা ক্রমাগত ঘটছে।
এমএসএফের তথ্য বলছে, মে মাসে সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেড়েছে, সীমান্তে হতাহতের মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি; বরং উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। অপর দিকে গণপিটুনির মতো আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনাও কমেনি।
হেফাজতে মৃত্যু কমিয়ে আনার জন্য কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?
পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা বলছিলেন এই ধরণের মৃত্যুর ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য প্রচলিত আইনি সাহায্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চেষ্টা থাকা উচিত। তিনি বলছিলেন “তারা প্রাথমিক পর্যায়ে সাহায্যের জন্য মানবাধিকার কমিশনে যেতে পারে, সেখানে তদন্তে কী আসলো সেটা দেখতে পারে। পরে নিম্ন আদালত ,উচ্চ আদালত রয়েছে। যেকোন ফৌজদারি কেস থানায় না নিলে আপনি আদালতে যেতে পারেন। এছাড়া এ ধরণের কাজের সাথে যারা জড়িত (পুলিশ) তাদের দ্বারা এই ঘটনা ঘটবে না এটা একেবারে বলা যায় না। তবে এটা কমিয়ে আনায় উচিত। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চেষ্টা থাকতে হবে যাতে করে এধরনের পেশাদার বাহিনীকে তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন।”
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন এ বলা হয়েছে “কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে যদি নির্যাতন করেন এবং উক্ত নির্যাতনের ফলে উক্ত ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহা হইলে নির্যাতনকারী এই আইনের ধারা ১৩ এর উপ-ধারা (১) অনুযায়ী অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তজ্জন্য তিনি অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং উহার অতিরিক্ত দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন”।
কিন্তু এই আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিজেদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এর কিছু ধারা পরিবর্তন করার জন্য বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশও করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম এই আইন হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে কতখানি সুরক্ষা দিচ্ছে? আর আইন পরিবর্তনের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী?
তিনি বলছিলেন “এই আইনের কিছু ত্রুটিতো আছেই। এই আইনটাকে রিফাইন করতে হবে। যারা হেফাজতে মৃত্যুবরণ করবে তাদের পরিবার যাতে করে সুরক্ষা পায় এবং এই দৃষ্টান্ত যাতে স্থাপন হয় যে হেফাজতে মৃত্যু হলে সেটা আমরা সাধারণভাবে গ্রহণ করবো না। এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিবো”।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে প্রত্যেক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সেটা ব্যাপক উদ্বেগজনক।
আনিসুল হকের কাছে প্রশ্ন করা হয় প্রত্যেক বছর অন্তত ৪০/৫০ টা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা দিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো, কেন এটা কমিয়ে আনা যাচ্ছে না বা কেন এমনটা হচ্ছে?
তিনি বলেন “যদি ৫ জনেরও মৃত্যু হয় সেটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া একটা সমষ্টিগতভাবে কোন বাহিনী করছে এমন নয় কারণ আমরা তদন্ত করতে যেয়ে দেখেছি এটা একটা ব্যক্তি বিশেষের কাছে। তবে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে আইনটি হচ্ছে সেটাতে যেখানে হেফাজতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার সঠিক বিচার হবে, একই সাথে অযথা যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হয় সেটাও দেখা হবে”।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে প্রত্যেক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সেটা ব্যাপক উদ্বেগজনক। এদিকে এই সংক্রান্ত যে আইন আছে সেটা পরিবর্তনে সুপারিশ করেছে কয়েকটি বাহিনী। অন্যদিকে পরিবারগুলো বিচার চাওয়ার পরিবর্তে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে এখন আতঙ্কে দিন পার করছেন। এই অবস্থায় আইনমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী বিদ্যমান আইনটি পরিবর্তন হয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের উপকারে কতখানি আসবে সেটার উপর নজর থাকবে।
এসদব্লিউ/এসএস/১১৪৫
আপনার মতামত জানানঃ