পাবনার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগরের ভেজাল দুধ কেলেঙ্কারি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার গভীর দুর্বলতা ও দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার প্রতীক। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটার মতো একটি বড় এবং দীর্ঘদিনের আস্থাভাজন ব্র্যান্ডে যদি ডিটারজেন্ট, তেল, সোডা ও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মিশ্রিত দুধ ঢুকে যেতে পারে, তবে বোঝাই যায়—সরবরাহ শৃঙ্খলে কোথাও না কোথাও ভয়াবহ ফাঁকফোকর আছে। ৭ আগস্ট ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে স্থানীয় বাসিন্দা তারেক হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মুন্নী খাতুন হাতেনাতে ধরা পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা এই ভেজাল দুধ তৈরি করে বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটায় সরবরাহ করছিলেন। আদালত তারেককে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা এবং মুন্নী খাতুনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা দেন।
এই ঘটনায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে—প্রথমত, কেন এবং কীভাবে এত বড় পরিসরে ভেজাল দুধ তৈরি হলো অথচ তা ধরা পড়ল না? দ্বিতীয়ত, এতদিন ধরে এই দুধ মিল্ক ভিটার মতো প্রতিষ্ঠানে পৌঁছাল কীভাবে? রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কাঁচা দুধ সংগ্রহের সময় মান পরীক্ষা করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে এই পরীক্ষা অনেক সময় কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষার মানদণ্ড শিথিল করা হয় বা যথাযথ ল্যাব পরীক্ষার বদলে কেবলমাত্র দুধের চেহারা, গন্ধ ও ঘনত্ব দেখে অনুমান করা হয়। এর ফলে দক্ষভাবে ভেজাল মিশ্রণ করা হলে সেটি সহজেই পরীক্ষার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যায়।
ডিটারজেন্ট, তেল ও সোডা মিশ্রিত দুধ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ডিটারজেন্টে থাকা রাসায়নিক উপাদান পাকস্থলী ও অন্ত্রের আস্তরণ ক্ষতিগ্রস্ত করে, যকৃত ও কিডনির উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। সোডা অতিরিক্ত গ্রহণ করলে পেটের সমস্যা, অম্লতা, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সাধারণত জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার হয়, কিন্তু খাদ্যে এর উপস্থিতি মারাত্মক বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে। শিশু, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধদের জন্য এই ঝুঁকি আরও বেশি। বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহুরে বহু পরিবার দৈনিক দুধ পান করে—পায়েস, চা, মিষ্টি বা সরাসরি—ফলে এই ভেজাল দুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য এক নীরব বিপর্যয়।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই ঘটনা উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের দুধ শিল্প একটি ক্রমবর্ধমান খাত। দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার কাঁচা দুধ কিনে। কিন্তু সরবরাহ শৃঙ্খলে যদি ভেজালের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে দেশি ব্র্যান্ডের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হবে। মানুষ বিকল্প হিসেবে গুঁড়ো দুধ বা বিদেশি ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকবে, যা স্থানীয় উৎপাদকদের জন্য বড় ধাক্কা। মিল্ক ভিটার মতো প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ণ হলে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারাবে, যা সরাসরি দেশের দুধ উৎপাদক কৃষকদের উপর প্রভাব ফেলবে।
ভেজাল দুধ তৈরির মূল উদ্দেশ্য আর্থিক লাভ। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খাঁটি দুধের ঘনত্ব ও স্বাদ বজায় রাখতে সঠিক খাদ্য ও যত্ন প্রয়োজন, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। কিন্তু ডিটারজেন্ট, তেল, সোডা মিশিয়ে দুধের ঘনত্ব ও রং সহজেই বাড়ানো যায়। এতে উৎপাদন খরচ কমে যায় এবং মুনাফা বেড়ে যায়। বিশেষ করে মিল্ক ভিটার মতো বড় প্রতিষ্ঠান থেকে যদি প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ দুধ সরবরাহের চুক্তি থাকে, তবে কম দামে বেশি সরবরাহ দিতে এই ধরনের অবৈধ পদ্ধতি লোভনীয় হয়ে ওঠে।
আইনগতভাবে বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ এবং ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’-এর আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ। তারেক হোসেন ও মুন্নী খাতুনকে এই আইনেই সাজা দেওয়া হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে সাজা অল্পমেয়াদি এবং জরিমানা তুলনামূলক কম হওয়ায় অপরাধীরা পুনরায় একই কাজ করতে দ্বিধা করে না। খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, কঠোর শাস্তির পাশাপাশি সরবরাহ চেইনের প্রতিটি ধাপে নিয়মিত ও হঠাৎ পরিদর্শন, পরীক্ষাগার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি-নির্ভর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করাই সমস্যার মূল সমাধান।
এই ঘটনার তদন্তে ফরিদপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ছানাউল মোর্শেদ জানিয়েছেন, আরও কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে এবং অনুসন্ধান চলছে। এর মানে, এই ভেজাল চক্র একক কোনো পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং একটি নেটওয়ার্ক আকারে কাজ করছে। এই নেটওয়ার্কে স্থানীয় সরবরাহকারী, পরিবহনকারী, এমনকি কিছু অসাধু প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীও থাকতে পারে, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভেজাল পণ্য গ্রহণে চোখ বুজে থাকে।
জনসচেতনতার অভাবও এই সমস্যাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অধিকাংশ ভোক্তা জানেন না, কীভাবে ভেজাল দুধ চেনা যায়। কেউ কেউ জানলেও যাচাই করার সুযোগ পান না। ফলে বাজারে যে দুধই পাওয়া যায়, সেটি কিনতে বাধ্য হন। যদিও সহজ কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে ঘরে বসেই ভেজাল চেনা সম্ভব, যেমন—এক ফোঁটা দুধ পানিতে ফেলে দেখা, ডিটারজেন্ট থাকলে দুধ পানির সাথে সহজে মিশে যাবে ও ফেনা তৈরি করবে। কিন্তু এই জ্ঞান খুব কম মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রথমত, দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রতিটি ধাপে বাধ্যতামূলক রাসায়নিক পরীক্ষা চালু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি দুধ সরবরাহকারীর নিবন্ধন ও ট্র্যাকিং ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে যেকোনো সমস্যার উৎস দ্রুত চিহ্নিত করা যায়। তৃতীয়ত, ভেজাল দুধ উৎপাদনের জন্য শাস্তি শুধু জরিমানা বা স্বল্পমেয়াদি কারাদণ্ডে সীমাবদ্ধ না রেখে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড ও ব্যবসায়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। চতুর্থত, গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রচারণার মাধ্যমে ভোক্তাদের ভেজাল চেনার উপায় শেখাতে হবে।
পাবনার এই ঘটনাটি একটি সতর্কবার্তা—খাদ্য নিরাপত্তা কেবল আইন প্রয়োগের বিষয় নয়, এটি সামাজিক নৈতিকতারও প্রশ্ন। যারা সচেতনভাবে ভেজাল তৈরি করে, তারা শুধু আইন ভঙ্গ করছে না, বরং হাজারো মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের সাথে খেলছে। আর যারা দায়িত্বে থেকেও এই ভেজাল ঠেকাতে ব্যর্থ, তারা সমানভাবে দায়ী। মিল্ক ভিটার মতো প্রতিষ্ঠানের উচিত এই ঘটনার পর নিজস্ব সংগ্রহ নীতি ও পরীক্ষণ ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করা এবং জনসমক্ষে তা জানানো, যাতে আস্থা ফিরতে পারে।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহু চ্যালেঞ্জের মুখে—দুর্বল অবকাঠামো, পর্যাপ্ত পরীক্ষাগারের অভাব, জনবল সংকট, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব, যদি সরকার, প্রতিষ্ঠান, সরবরাহকারী ও ভোক্তা—সবাই একসাথে কাজ করে। ভেজাল দুধ কেলেঙ্কারি যেন কেবল একটি সংবাদ না হয়ে যায়, বরং এটি হোক একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা, যা বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে স্থায়ী পরিবর্তন আনার সূচনা করবে।
আপনার মতামত জানানঃ