বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে বা সিপিএস ২০২৫-এর ফলাফল একটি দারুণ বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছে দেশের নাগরিক সেবা, নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে। রিপোর্টটি স্পষ্ট করে বলছে, বাংলাদেশের নাগরিকরা এখনো সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘুষ ও দুর্নীতির ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বিআরটিএ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পাসপোর্ট অফিস ও ভূমি অফিস—এসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির অভিযোগে বারবার আলোচনায় এলেও বাস্তব পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
২০২৫ সালের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বিআরটিএ-তে সেবা নিতে গিয়ে ৬৩.২৯% সেবাগ্রহীতাকে ঘুষ দিতে হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (৬১.৯৪%), পাসপোর্ট অফিস (৫৭.৪৫%) এবং ভূমি অফিস (৫৪.৯২%) ঘুষের মাত্রায় শীর্ষে রয়েছে।
যদিও ঘুষ-দুর্নীতির এই দিকটি হতাশাজনক, রিপোর্টের অন্য অংশে কিছু ইতিবাচক বার্তাও আছে। যেমন—নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধ সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সন্ধ্যার পর নিজ বাড়িতে ৯২.৫৪% মানুষ নিরাপদ বোধ করেন। শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় নিরাপত্তাবোধ কিছুটা বেশি। আবার নারী-পুরুষের মধ্যে এ নিয়ে পার্থক্য থাকলেও, এটি এখনো আশাব্যঞ্জক যে অধিকাংশ নাগরিক অন্তত নিজ বাড়িতে বা আশপাশে নিরাপদ বোধ করেন। তবে নারী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে গ্যাপ রয়েছে, সেটি সামগ্রিক উন্নয়নের পথে একটা বড় বাঁধা হিসেবেই থাকবে।
রাজনৈতিক মত প্রকাশ এবং রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও এই জরিপে চিত্রটা মিশ্র। মাত্র ২৭.২৪% নাগরিক মনে করেন তারা সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মতামত দিতে পারেন, যেখানে পুরুষের হার ৩১.৮৬% আর নারীর মাত্র ২৩.০২%। একইভাবে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা নিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে স্পষ্ট বৈষম্য রয়েছে। এটি শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতা নয়, বরং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অভাবকেই সামনে নিয়ে আসে।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও জরিপটি কিছু ভালো দিক তুলে ধরেছে। গত এক বছরে ৪৭.১২% নাগরিক সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন এবং তাদের ৮২.৭২% বলেছেন, সেবাটি সহজলভ্য এবং ব্যয় সামর্থ্যের মধ্যে ছিল। এটি নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের একধরনের সাফল্য, যদিও ঘুষ-দুর্নীতির পাশাপাশি সেবার গুণমান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাগরিকদের সন্তুষ্টির হার তুলনামূলকভাবে ভালো। ৪০.৯৩% নাগরিকের কমপক্ষে একটি শিশু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে এবং ৯৬.৪৬% মনে করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সহজে প্রবেশযোগ্য। অধিকাংশ নাগরিক জানাচ্ছেন, ৩০ মিনিটের মধ্যেই যেকোনো শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে পারে। তবে মানসম্পন্ন শিক্ষার দিকটি এখনো ভাবনার বিষয়, কারণ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের এক-চতুর্থাংশ এখনো শিক্ষার মান নিয়ে অসন্তুষ্ট।
নাগরিক নিবন্ধন বা পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবাগুলোতে মানুষের সন্তুষ্টি তুলনামূলকভাবে বেশি। সেবাপ্রাপ্তির ব্যয় ছিল অধিকাংশের জন্য সামর্থ্যের মধ্যে এবং ৬২.৬% মানুষ সময়মতো ও সম-আচরণের ভিত্তিতে সেবা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এটি একধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চোখে পড়ে।
বিচারিক সেবার দিকেও রিপোর্টে নজর দেওয়া হয়েছে। গত দুই বছরে ১৬.১৬% নাগরিক কোনো না কোনো বিরোধ বা বিবাদে জড়িয়েছেন এবং তাদের ৮৩.৬০% বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রবেশাধিকার পেয়েছেন, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তবে এখানেও দেখা যায়, অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি (৬৮.৯৬%), যেখানে আদালত বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা পেয়েছেন মাত্র ৪১.৩৪%।
সব মিলিয়ে এই জরিপটি বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। একদিকে ঘুষ-দুর্নীতির করাল গ্রাস, অন্যদিকে কিছু ইতিবাচক দিক—এ দুইয়ের দ্বন্দ্বে আজকের বাংলাদেশ। সেবাগ্রহীতাদের দুর্দশা এবং আশা, দুর্নীতির দমন ও সুশাসনের পথচলা—সবকিছুই যেন এ প্রতিবেদনের ছায়ায় প্রতিফলিত। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এত জরিপ, এত তথ্য, এত বিশ্লেষণ—তার পরেও ঘুষ কমছে না কেন? নীতিনির্ধারকরা কি কেবল রিপোর্ট পড়েই ক্ষান্ত থাকবেন, নাকি সময় এসেছে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের? বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তরের ওপর।
আপনার মতামত জানানঃ