২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আকস্মিকভাবে দিল্লিতে আশ্রয় নেন। তাঁর হঠাৎ প্রস্থানের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়ার রিপোর্ট ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোর বিবরণে দেখা যায়, হাসিনাকে “রাষ্ট্রপ্রধানের মতো” নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেছেন তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি বলেছেন, তাঁর মা ভারতে নিরাপদ এবং স্বাধীনভাবে থাকতে পারছেন। অন্যদিকে, হাসিনাও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দাবি করেছেন যে তিনি দিল্লিতে স্বাচ্ছন্দ্যে অবস্থান করছেন। এর মধ্যেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ের আগে জয় সতর্ক করে বলেছেন, যদি আওয়ামী লীগের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা হয়, তাহলে তাঁদের সমর্থকরা ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন প্রতিহত করতে পারে, এবং বিক্ষোভ সহিংস রূপ নিতে পারে। এতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, যার প্রতিফলন ভারতেও পড়ছে।
ভারত এই পরিস্থিতিতে যে নিরাপত্তা প্রদান করছে তা নিছক মানবিক পদক্ষেপ নয়; বরং এটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের হিসেব–নিকেশও বটে। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্য, আঞ্চলিক নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার দিকগুলো ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সময়ে হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল—বাণিজ্য, যোগাযোগ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতায় দুই দেশ বহু প্রকল্প একসঙ্গে এগিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনাকে একেবারে পরিত্যাগ করা ভারতের পক্ষে কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক নয়। তাঁকে দিল্লিতে রাখা ভারতের কাছে একটি সম্ভাব্য “কার্ড”—যা ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবহার করা যেতে পারে।
হাসিনাকে নিরাপদে রাখা ভারতের জন্য আরও একটি কারণে যুক্তিসঙ্গত—বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হওয়া মামলা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়, দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে নয়া উত্তাপ সৃষ্টি করেছে। হাসিনা এই বিচারকে “রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পূর্বনির্ধারিত রায়” বলে আখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে বিচার স্বচ্ছ ছিল এবং পর্যবেক্ষকদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার মধ্যে ভারত যদি হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বিবেচনা করে, তবে তা ভারতের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে বড় পরিবর্তন এনে দিতে পারে। এমন সিদ্ধান্তে ভারতের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতকে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে দেখা হয়, এবং একসময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্রকে হস্তান্তর করলে আঞ্চলিক জোটনীতি তীব্র চাপে পড়বে।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ভারত আপাতত হাসিনাকে “নিগরানাধীন স্বাধীনতা” দিয়েছে। অর্থাৎ, তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে, এমনকি কিছু সুবিধাও — কিন্তু রাজনৈতিক কার্যক্রমে তিনি কতটা সক্রিয় হতে পারবেন, তা ভারতের নীরব নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে। তাঁর বাসস্থান নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখা, সংবাদমাধ্যমে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়ার সময়সমূহে সংযম—এসবই ইঙ্গিত দেয় যে ভারত তাকে সম্পূর্ণ অবাধ রাজনৈতিক স্পেস দেয়নি। কারণ, হাসিনা যদি ভারতে বসে বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে কঠোর রাজনৈতিক বক্তব্য দেন, তবে তা বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ককে উত্তপ্ত করে তুলবে, যা দিল্লি কোনভাবেই এখন চায় না।
এখন প্রশ্ন উঠছে, ভারত কি আসলে হাসিনাকে দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা দেবে, নাকি পরিস্থিতি অনুকূলে এলে তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা রাখছে? “বন্দি বিনিময়” শব্দটি এখানে সরাসরি প্রয়োগযোগ্য না হলেও, কূটনৈতিক ‘বিনিময়নীতি’ অবশ্যই এখানে কার্যকর। বাংলাদেশ যদি ভারতকে নির্দিষ্ট ধরনের সহযোগিতা চায়—যেমন সীমান্ত নিরাপত্তা, যোগাযোগপথে চুক্তি, বা আঞ্চলিক প্রভাবের আলোচনায় ছাড়—তাহলে ভারত হয়তো ভবিষ্যতে হাসিনার অবস্থান নিয়ে সমঝোতায় যেতে পারে। ভারতীয় কূটনৈতিক চর্চায় এমন বেশ কয়েকটি উদাহরণ রয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তির অবস্থান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে।
তবে বর্তমান বাস্তবতায় হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত ভারতের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রথমত, বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করার পরিবেশ তৈরি হলে তা আন্তর্জাতিক মহলে মানবাধিকার আলোচনা উসকে দেবে। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় সমাজের একটি অংশ ও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন—হাসিনা সীমান্ত নিরাপত্তা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অংশীদার ছিলেন। ফলে তাঁকে “হস্তান্তর” করা হলে ভারতের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতির সামঞ্জস্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তৃতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন—যে কোন সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বাড়াতে পারে। তাই ভারতের দৃষ্টিতে হাসিনা একটি ‘স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেট’, যাকে এখনই ছাড়ার ঝুঁকি নিতে চায় না।
এই অবস্থায় সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাম্প্রতিক মন্তব্য যে, তাঁদের দল নির্বাচনে অংশ না নিলে সমর্থকরা নির্বাচন প্রতিহত করতে পারে, বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে। কারণ, ভারতের নিরাপত্তা প্রশাসন চায় না যে তার মাটিতে আশ্রয় নেওয়া কোনো নেতা বা তাঁর অনুসারীরা ভারতের আশ্রয়কে রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করুন। এতে ভারত তার নিরপেক্ষ অবস্থান হারাতে পারে। ফলে ভারত নিশ্চয়ই চায় হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বক্তব্য নিয়ন্ত্রিত থাকুক—যা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ভারতের প্রতি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে। তাঁরা দাবি করেছেন, হাসিনা ভারতে বসে “মিথ্যা বিবৃতি” দিচ্ছেন এবং ভারত যেন তাঁকে এসব করা থেকে বিরত রাখে। এতে বোঝা যায়—বাংলাদেশ সরকার ভারতের ভূমিকা খুবই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ভারতও নিজেদের অবস্থানকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সাজাচ্ছে।
সুতরাং মোট চিত্রটি হলো—ভারত এখন হাসিনাকে এক ধরনের “সুরক্ষিত রাজনৈতিক কোয়ারেন্টাইন”-এ রেখেছে। তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে, বিবৃতি দেওয়ার সীমিত স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারতের নিজের কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশ চালু আছে। এটি নিছক মানবিক আশ্রয় নয়, আবার পুরোপুরি রাজনৈতিক আশ্রয়ও নয়। বরং দুইয়ের মিশেল—একটি কৌশলগত ‘হোল্ডিং প্যাটার্ন’, যেখানে ভারত ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির অপেক্ষায় আছে।
হাসিনাকে এখনই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কোনো ইঙ্গিত নেই। তবে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সমঝোতা, আন্তর্জাতিক চাপে ভারসাম্য বদলে গেলে বা ভারতের কৌশলগত মূল্যায়নে পরিবর্তন এলে বিষয়টি নতুন দিকে মোড় নিতে পারে। আপাতত ভারতের মূল লক্ষ্য—বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে হাসিনাকে নিরাপদে রাখা। তাই ভারত হাসিনাকে সত্যিই নিরাপত্তা দিচ্ছে, কিন্তু তার পেছনে কূটনৈতিক হিসাব আরও গভীর—এটি যে কোনো সময় নতুন বাস্তবতায় রূপ নিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ