রানীপাড়া গ্রামের রাস্তায় রাতের অচেনা আলোয় যখন কেবল পায়ের আওয়াজ আর দূরের কোনো গাড়ির হেডলাইট ছিল, তখনই হঠাৎ জনজোড়া গড়ে ওঠে। আড়াল থেকে এগোনো মানুষগুলো একে একে ঘিরে ধরে। তাদের হাতে লাঠি, চোয়াল পর্যন্ত কাদামাখা; মুখে ছিল কিছু বাক্য বারবার বলানোর তাগিদ। মুর্শিদাবাদ জেলার চক হরেকৃষ্ণপুরের ২৪ বছরের রাহুল ইসলামের কাছে তিনি তাঁর আধার কার্ডটি তুলে ধরলে শুরু হয় অভিযুক্ত অভিযোগ ও অসম্মান। একে বলেন ‘ভুয়া’, একে বলেন ‘বাংলাদেশি’, কেউ কেউ আবার উচ্চস্বরে ঘোষণা করে তাকে ‘রোহিঙ্গা’ বলেও আতঙ্কিত করেন। তারপরই শুরু হয় মারধর — চড়, থাপ্পড়, লাঠির আঘাত; কেউ লাথিও মারে। আহত রাহুলকে দাঁত-চোড়া কাটা কাপড়ের মতো কপালে লেগে থাকা কালো দাগ, পেটের ওপর লাঠির নির্দোষ দাগহীন লালচে দাগ দেখাতে বাধ্য করে সত্যের সাথে লড়াই করা। তাকে বলতে বাধ্য করা হয় স্লোগান — “জয় শ্রীরাম”, “ভারত মাতার কি জয়” — কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাতেোহতে বাধ্য হওয়া এক প্রকার ভৌত আত্মসমর্পণ। ভিডিও তো আছে; তার হাতছানি করে থাকা আতঙ্ক আর অপ্রতিরোধ্য নির্যাতনের আভাস স্পষ্ট।
এই ঘটনা শুধু এক ব্যক্তির ওপর নির্যাতন নয়; এটি বৃহত্তর রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশের প্রতিফলন যেখানে পরিচয়, শ্রেণী ও জাতীয়তার প্রশ্ন খুব সহজেই সহিংসতায় পরিণত হয়। পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে গিয়েছিলেন রাহুল — ওড়িশার গঞ্জাম জেলার রানীপাড়া গ্রামে গিয়ে কাজ করা ছিল তাঁর অভাবনীয় রুটিন। পরিযায়ী শ্রমিকরা নিয়মিতই এখানে-বসে থাকেন, ফেরি বস্ত্র বিক্রি করে কিংবা ঠিকাদারি কাজ করে দিনগুণে কেটে যায়। কিন্তু পরিচয় যাচাইয়ের নাম করে আচরণ যদি ধারাবাহিকভাবে সন্দেহভাজন বাংলাদেশি খুঁজে বার করাকে কেন্দ্র না করে, তবে সেটি রাহুলের মতো অনেকের ওপর প্রতিনিয়ত দমন ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
অভিযুক্তদের বক্তব্য ও পুলিশি প্রতিক্রিয়ার মধ্যে মেলেনা। মাইনুল সরকার, যিনি রাহুলের সঙ্গেই একই ভাড়ায় ছিলেন, BBC-কে জানান যে তারা স্থানীয় থানায় অভিযোগ করতে গিয়েও সঠিক সহযোগিতা পাননি। থানায় অভিযোগ নেয়ার সময় পুলিশ যেটা বলেছে — “এই অভিযোগ নেবে না” — তা প্রশ্ন তোলে। একই সঙ্গে থানার ওসি যে জানাননি কোনো খবর আছে, অথচ হাসপাতাল ও স্থানীয়দের নিকট থেকে পাওয়া তথ্য ইঙ্গিত করে অন্যরকম বাস্তবতা। হাসপাতাল রিপোর্ট এবং আহতের তীব্র কষ্টের বিবরণ এই মুহূর্তে এক ব্যক্তি হয়েই দেশজোড়া বিতর্কের গল্প বলে দেয়। ভুক্তভোগী ও তার সঙ্গীরা ফের হোম গ্রামের পথে ফিরে আসে। তারা জানায় পুলিশ তাদের পুনরায় ডেকে পরিচয় যাচাই করায়, তবু সন্দেহ থাকলে কেন অবিলম্বে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো না—এই প্রশ্ন ঝুলে আছে।
ওড়িশার রাজ্য প্রশাসন বলছে তারা “সন্দেহভাজন” ব্যক্তিদের শনাক্তের কাজ চালাচ্ছে; পুলিশও জানিয়েছে অভিযানে কিছু মানুষকে ডেকে পরিচয় যাচাই করা হচ্ছে। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিক সংগঠনগুলি বলছে, এই পরিচয় যাচাইয়ের নামে অনাবশ্যক ও অকারণভাবে আটক রাখা হচ্ছে, অনেককে তিন দিন, পাঁচ দিন পর্যন্ত আটক করা হয়েছে,ায়ে আদালতে তোলা হয়নি। এগুলো সংবিধানগত প্রক্রিয়ার পরিপন্থি। এসব অভিযোগে একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে, যেখানে বিভিন্ন রাজ্যে একই কায়দায় পশ্চিমবঙ্গের লোকজনকে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে ধাওয়া করা হয়েছে, তাদের নথি যাচাই করা হলেও বৈধতা স্বীকৃতি পেলেও অন্যভাবে স্টিগমা থেকে যায়। ওড়িশার রাজ্যসভায় যে তত্ত্ব উঠে এসেছে — ৩৭৪০ জন বাংলাদেশিকে খুঁজে পেয়েছে রাজ্য — সেটা থেকেই টান পড়ে নানা জায়গায়। রাজনৈতিক বক্তৃতা ও প্রশাসনিক জোরালো পদক্ষেপের মিশেলে সাধারণ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে। রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন ও রাজ্যীয় বাতাবরণ যখন পরিবর্তিত হয়, সেখানে সংখ্যালঘু ও পরিযায়ী জনগোষ্ঠীর ভুমিকা সহজেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়।
এইসব ঘটনার পেছনে আছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কিছু অংশের সক্রিয়তা। “জয় শ্রীরাম” ও “ভারত মাতার কি জয়” স্লোগানগুলো এখন শুধু ধর্মীয় ধ্বনিতে সীমাবদ্ধ নয়; এগুলোকে রাজনৈতিক পরীক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়—কেউ কেউ এগুলোকে দেশের প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষা হিসেবে ভাবেন। যখন এই স্লোগান বাধ্যতামূলকভাবে বলানো হয় আর সেটা অমান্য করলে শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয়, তখন সেটি একধরনের ধমক-দামকি ও সামাজিক নির্মমতার আভাস দেয়। এখানে প্রসঙ্গত যে বাংলাদেশের নাগরিক ও রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করার আগ্রহ বাড়ছে—এটি স্থানীয় স্তরে হিংসার ঝুঁকি বাড়ায়, কারণ কোনো সদৌরূপে যাচাই করা না হলে ‘অবৈধ’ আখ্যা সহজেই দেয়া যায় এবং পরে তা পুলিশি বা সমাজিক পর্যায়ে শাস্তিতে পরিণত হয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ ঠিক থাকলেও জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? এসব প্রশ্ন এখন নীরব চাপের মতো জীবিত।
এই ঘটনা সামাজিক-আইনি দিক থেকেও চিন্তার বিষয়। সংবিধানগত অধিকার, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ন্যায্য বিচারপ্রক্রিয়া, আটক-নির্যাতন ও ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সক্রিয় তদন্ত—এসবই প্রশ্ন উঠছে। স্থানীয় থানার বক্তব্য, জেলা পুলিশের বক্তব্য এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সবসময় একসাথে মেলে না। ন্যায্য আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বে থাকা পুলিশ যখন কোনো অভিযোগ নেনা বা উপেক্ষা করে, তখন ন্যায়বিচার কাঠামোও স্তব্ধ থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কেবল ফিজিক্যাল ক্ষতির সম্মুখীন হয় না; তাদের মানসিক ভাঙন, সামাজিক লাঞ্ছনা ও অর্থনৈতিক ক্ষতিও দীর্ঘস্থায়ী হয়। যাদের বসবাস হুমকির মুখে পড়ে, তাদের ঘর ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়—এটা কেবল এক ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এতে বহু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের জীবিকা, ব্যবসা ও সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে যায়।
রাজনৈতিক পরিণতির কথাও বাদ দেওয়া যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্র এই ঘটনার কথা সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরেন এবং ওড়িশা পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন। রাজনৈতিক প্রতিই উত্তরাধিকারী এই ধরনের ঘটনার পেছনে প্রতিটি দলের একটি স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা দেখা যায়—একদিকে প্রশাসনিক ব্যাখ্যা, অন্যদিকে রাজনৈতিক বাঁক। তৃণমূল, বিজেপি—দুই পক্ষই এই ঘটনার ওপর নিজেদের রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছে। খবরগুলোর মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, কেবল একাধিক জনের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতা নয়, এটি এখন রাজনৈতিক বিতর্কের একটি মাধ্যমও হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে, পরিযায়ী শ্রমিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই ধরণের হেনস্থা দেশের আরেক রূপকে সাজায়—একটি ভীতিযোগ্য, বিভক্ত সমাজ যেখানে অধিকার ও নাগরিকতার ভিত্তিতে মানুষকে অসম্মানিত করা হয়। তাদের মতে, প্রশাসনকে উচিত এই অভিযোগগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা; অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া এবং আক্রান্তদের পুনর্বাসন করা। ন্যাশনাল সংখ্যালঘু কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনে ই-মেইল করার কথা বলা হয়েছে—তবে প্রতিষ্ঠাগুলো কি কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এই ঘটনার আরেকটি দিক হলো সামাজিক সম্পর্কের ক্ষয়। বহু বছর ধরে বাংলা–ওড়িশা সীমান্ত ও বহু জেলায় মানুষগুলো আন্তঃনির্ভরতার মধ্যে বাঁচে—মেলায় কাজ, বাজারে একই জায়গায় আসে, বন্ধুত্ব ইত্যাদি গড়ে ওঠে। এই ধরণের অভিযানের ফলে সেই আঁতাত সহজে বিচ্ছিন্ন হতে পারে। হেনস্তার ভয় মানুষকে তাদের প্রবাসী কাজগুলোতে যেতে ভয় দেখায়; পরিবারগুলো বাকী থাকবে আর জীবিকা সংকুচিত হবে। ব্যবসা-ব্যবসায়ী লোকেরা যখন এলাকাবাসীর চাপে বাধ্য হয় বাড়ি খালি করে চলে যেতে, তখন স্থানীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রত্যেকটি পরিবার নয়, পুরো সমাজ প্রভাবিত হয়—এটাই বড় বিষয়।
সবশেষে এসে প্রশ্ন জমে ওঠে—কীভাবে এমন পরিস্থিতি রোধ করা যায়? প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, আইনি পুনর্ব্যবস্থা, দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—সামাজিক চেতনা জাগ্রত করা। মানুষকে শেখাতে হবে যে পরিচয়ের ভিত্তিতে হেনস্থা করা মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নিয়ে অবমাননাকর আচরণ কেবল অপরাধ নয়; এটি সমাজকে দুর্বল করে। স্থানীয় পুলিসকে প্ররোচিত করতে হবে ন্যায্য পদ্ধতিতে কাজ করতে, যাতে কোনো ব্যক্তির অধিকার বিনা বিচারে বিসর্জিত না হয়। রাজনৈতিক নেতাদেরও উচিত উত্তেজনা না বাড়িয়ে সমস্যার মূলে কাজ করা—কেননা যে কোনো অসতর্ক মন্তব্য বা বহিরাগত দোষারোপ তরার ওপর আগুন ছড়িয়ে দিতে পারে।
রাহুল ইসলামের অভিজ্ঞতা—ভিডিও, আহত দেহ, হাসপাতালে চিকিৎসা, থানায় অভিযোগ এবং পুলিশি অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা—এসবই এক বৃহত্তর উপাখ্যান বলছে: পরিচয়ভিত্তিক সত্তা বলে কোনো মানুষের অধিকার কেবল একটি প্রমাণপত্রে সীমাবদ্ধ করে ফেলা যায় না। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, সামাজিক সম্মান ও নাগরিক অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে হলে আমাদের সমাজকে সহনশীল ও ন্যায়নিষ্ঠ হতে হবে। অনাবশ্যক আতঙ্কে কোনো মানুষের জীবন ধ্বংস করা হলে সে ক্ষতি শুধুই ব্যক্তিগত নয়—সমগ্র সমাজের মনুষ্যত্বে আঘাত লাগে। এই গল্পটি তাই কেবল রাহুলের নয়; এটি আমাদের সবাইয়ের—একজন মানুষের উপর উথালপাথাল যে কোনো সমাজকেই নীরব প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করে, আমরা কি সেই প্রশ্নের জবাব দেব কি না, তা সময়ই ঠিক করে দেবে।
আপনার মতামত জানানঃ