বাংলাদেশে যৌন হয়রানি নিয়ে জনমত, আলোচনার ভাষা এবং নীতিনির্ধারণী চিন্তাধারা আজও এমন এক কাঠামোর মধ্যে আটকে আছে, যেখানে যৌন নিপীড়নের ভুক্তভোগী হিসেবে শুধু মেয়েশিশু বা নারীর কথাই ওঠে। এই সামাজিক ধারণা এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত যে বহু পরিবার, শিক্ষক, এমনকি আইন প্রয়োগকারীরাও অনুধাবন করতে পারেন না—ছেলেশিশুরাও একইভাবে, কখনো আরও নির্মমভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ঘটনাগুলো প্রকাশ না পাওয়ার পেছনে আছে ভয়, লজ্জা, সামাজিক ট্যাবু এবং ভুল ধারণা। ফলে ছেলেদের প্রতি যৌন নিপীড়নের ইতিহাস যেন নীরব অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকে; আর এই অন্ধকারের সুযোগেই অপরাধীরা বছরের পর বছর ধরে ছেলেশিশুদের ওপর বিধ্বংসী নিপীড়ন চালিয়ে যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক অধ্যাপককে গ্রেপ্তারের ঘটনা এই অচিন্তনীয় বাস্তবতাকে নতুনভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। সমাজের একটি বড় অংশ এমন ঘটনায় অবাক হলেও যারা দীর্ঘদিন শিশু-কৈশোর মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন, তারা জানেন—ছেলেদের যৌন নির্যাতন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং আমাদের চোখের সামনে, আমাদের আশপাশে, এমনকি আমাদের পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই বহু ছেলে নীরবে শিকার হয়ে যাচ্ছে। তাদের অধিকাংশের গল্প কখনো সংবাদ শিরোনামে আসে না; আসে না অভিভাবকদের ভাষায়, অভিযোগের খাতায় বা আইনের কাঠগড়ায়।
প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত ৪৫ জন ছেলেশিশু ধর্ষণ বা বলাৎকারের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ২৮টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। বয়সসীমা ৭ থেকে ১২ বছর—যে বয়সে একটি শিশু বিশ্বাস, স্নেহ ও নিরাপত্তার পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার কথা। কিন্তু পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বাস্তবতা কত ভিন্ন। এই সংখ্যা আসলে কেবলমাত্র সেই অংশ, যা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। প্রকৃত সংখ্যা কত গুণ বেশি হতে পারে, কেবল অনুমানই করা যায়।
যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধী হিসেবে উঠে আসে পরিচিত মানুষ—আত্মীয়, শিক্ষক, মাদ্রাসা বা আবাসিক হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, পারিবারিক বন্ধু, বাসার গার্ড, ড্রাইভার বা গৃহকর্মী। মনোচিকিৎসকরা বলেন, অপরিচিত কারো দ্বারা শিশু নির্যাতনের ঘটনা তুলনামূলক কম; অধিকাংশ সময়েই শিশুটি চেনে এমন কেউ অপরাধী হয়। বিশ্বাস, স্নেহ ও নৈকট্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অপরাধীরা ধীরে ধীরে শিশুটিকে নিয়ন্ত্রণের চক্রে নিয়ে আসে। ভয় দেখানো, চুপ থাকতে বাধ্য করা, শারীরিক নির্যাতনের হুমকি দেওয়া বা সুবিধার প্রতিশ্রুতি—এসব তাদের সাধারণ কৌশল।
ছেলেশিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন যে শুধু পুরুষ অপরাধীর মাধ্যমেই ঘটে, তাও নয়। সামাজিক ট্যাবুর কারণে এই সত্যটিও কোথাও বলা হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ছেলেরা নারীর দ্বারাও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারে। প্রকাশ না করলে বা মানতে না চাইলে সত্য মুছে যায় না। শিকদার আলীর মতো শিশুদের গল্প এই সত্যেরই প্রতিচ্ছবি—যারা ঘরের মানুষের কাছেই মানসিক ও শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, অথচ বছরের পর বছর কাউকে কিছু বলতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত ঘটনাটিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে সোচ্চার হয়েছেন, তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন, তা এক ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু একইসঙ্গে প্রশ্ন তোলে—আরও কতজন শিক্ষার্থী বছরের পর বছর চুপ করে গেছেন? কতজন ভয়, হুমকি ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাবের কারণে অভিযোগ করার সাহস পাননি? অপরাধী শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই ঘটনা বরফের চূড়া ছাড়া আর কিছু নয়।
ছেলেদের যৌন হয়রানি নিয়ে সামাজিক নীরবতা যে কত ভয়াবহ তা বোঝা যায় অভিভাবকদের আচরণ দেখলে। অনেকেই ধরে নেন—ছেলের কিছু হবে না, তাকে কেউ বলাৎকার করবে না, তাকে কেউ যৌন হয়রানি করতে পারবে না। ফলে বাবা-মা ছেলেকে কোনো সতর্কবাণী দেন না। ‘গুড টাচ’ বা ‘ব্যাড টাচ’—এই মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো হয় মেয়েদের, ছেলেদের নয়। আর ঠিক এই ভুল ধারণাই অপরাধীদের সবচেয়ে বড় সুযোগ সৃষ্টি করে। কারণ, ছেলেরা জানেই না তাদের সঙ্গে যা হচ্ছে তা অপরাধ; জানলেও অনেকে বিশ্বাস করতে পারে না অন্য কেউ তাদের এমনভাবে শোষণ করতে পারে।
সমাজে ছেলেদের যৌন হয়রানি এখনো এক ভয়ংকর ট্যাবু। এই ট্যাবু ভাঙতে না পারলে যৌন নিপীড়নকারীদের হাত আরও লম্বা হবে। যারা শাসন করে, ভয় দেখায়, হুমকি দেয়—তারা জানে সমাজ এই বিষয়ে কথা বলতে লজ্জা পায়। তাই ভিকটিম যত বেশি চুপ থাকবে, তাদের ক্ষমতা ততই বাড়বে। যৌন নিপীড়নের প্রতিটি ঘটনার পেছনে থাকে এই নীরবতার কালো ছায়া।
আইনের দুর্বলতাও সমস্যার শিকড়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংজ্ঞাগুলো এখনো নারী কেন্দ্রিক। ছেলেশিশুদের প্রতি ধর্ষণ বা বলাৎকারকে যেভাবে দেখা উচিত ছিল, আইন এখনো তা স্পষ্ট করে না। ফলাফল—পুলিশের তদন্ত, চিকিৎসা রিপোর্ট, বিচারকার্য—সবকিছুতেই দেখা যায় অবহেলা। তদন্ত দুর্বল হলে বিচার হয় না, বিচার না হলে অপরাধী উৎসাহিত হয়। আইনের এই বৈষম্য দূর না করলে সমাধান অসম্ভব।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহির কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো নেই। যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ নীতিমালা, আচরণবিধি বা অভিযোগ গ্রহণ কমিটি—এসব কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই। অথচ অভিভাবকরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস নিয়ে সন্তানদের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় পাঠান। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতেই যখন ছেলেশিশুরা শিকার হয়, তখন সমাজের নিরাপত্তা বোধ ভেঙে পড়ে।
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন সহিংসতার বহু ঘটনা রয়েছে—নান্দাইলের ঘটনা, নাসিরনগরের ঘটনা—যেখানে ভিকটিম পরিবার প্রথমে লোকলজ্জার ভয়ে চুপ থেকেছে। এই নীরবতা শুধু ভিকটিমের ক্ষতি করেনি; অপরাধীদেরও আরও সুযোগ করে দিয়েছে। অভিভাবকরাও বলেছে, ‘আজ আমার ছেলের সঙ্গে হয়েছে, কাল অন্য কারো হবে।’ এ উপলব্ধি যখন আসে, তখন তারা মামলা করে। কিন্তু তখন পর্যন্ত অপরাধী হয়তো আরও অনেক শিশুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছে।
ছেলেশিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনের বিষয়টি আইনি, সামাজিক, শিক্ষাগত এবং মনস্তাত্ত্বিক—চার দিক দিয়েই গুরুত্ব দাবি করে। প্রথমত, আইনকে স্পষ্টভাবে ছেলেশিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; যৌন অপরাধের সংজ্ঞায় লিঙ্গভেদ তুলে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা ও কার্যকর কমিটি গঠন করতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক—সবার জন্য সচেতনতা কর্মসূচি চালাতে হবে। চতুর্থত, ভিকটিমকে দ্রুত ও সহজে অভিযোগ জানানোর নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এবং সর্বোপরি, সমাজকে বুঝতে হবে—ছেলেদের যৌন নিরাপত্তা নিয়ে চুপ থাকা কোনো বিকল্প নয়।
শিশু ছেলেদের যৌন নিপীড়ন নিয়ে নীরবতা মানে অপরাধীর প্রতি নীরব অনুমতি। শিশুরা যখন বাড়িতে, স্কুলে, মাদ্রাসায়, আবাসিক হলে, কর্মক্ষেত্রে বা আত্মীয়ের ঘরে যৌন হয়রানির শিকার হয়, তখন তারা শুধু শারীরিক ক্ষতিই বহন করে না—তাদের আত্মবিশ্বাস, স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা, ভবিষ্যৎ সম্পর্ক, মানসিক স্বাস্থ্য সবকিছুই বিপর্যস্ত হয়ে যায়। অনেকেই কৈশোর বা তারও পরে এসে ট্রমার সাথে লড়াই করেন—দোষী নয়, ভিকটিম হওয়া সত্ত্বেও।
সময় এসেছে এই নীরবতা ভাঙার। ছেলেদের নিয়ে ট্যাবু ভেঙে সচেতনতা বাড়াতে না পারলে তারা অরক্ষিতই থেকে যাবে। সমাজকে জানতে হবে—যৌন হয়রানি লিঙ্গ দেখে আসে না। ভিকটিম ছেলে হোক বা মেয়ে, অপরাধ একই। অপরাধীর লিঙ্গ, বয়স, সামাজিক অবস্থান বা পারিবারিক পরিচয় কোনো গুরুত্ব বহন করে না—বরং গুরুত্ব বহন করে অপরাধের প্রকৃতি ও ভিকটিমের কষ্ট।
ছেলেদের যৌন নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলা, শিশুদের নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন করা, গুড টাচ-ব্যাড টাচ শেখানো, সন্দেহজনক আচরণ দেখলে তা জানাতে উৎসাহিত করা—এসবই এখন জরুরি। সমাজ, পরিবার, শিক্ষক এবং নীতিনির্ধারকের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব।
শেষ পর্যন্ত, এই সত্যটিই উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন—যে ভিকটিমের লিঙ্গ নয়, বরং শিশুর নিরাপত্তাই আমাদের প্রথম বিবেচ্য হওয়া উচিত। নীরবতা ভাঙা মানে কেবল অপরাধীকে থামানো নয়; বরং শৈশবকে বাঁচানো, একটি প্রজন্মকে বাঁচানো, এবং ভুক্তভোগী শিশুদের পাশে দাঁড়ানো। আর সমাজ যদি এ দায়িত্ব না নেয়, তাহলে ছেলেদের ওপর যৌন নির্যাতনের অদৃশ্য এই অন্ধকার আরও গভীর হবে—আরও ভয়ংকর হবে।
আপনার মতামত জানানঃ