দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনের উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা আজ জাতীয় আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক তাপমাত্রা যেমন বেড়ে যায়, তেমনি বাড়ে প্রশাসনিক চাপ, সামাজিক উত্তেজনা এবং সাধারণ মানুষের উদ্বেগ। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের আশঙ্কা, সহিংসতা, দাঙ্গা বা রাজনৈতিক সংঘর্ষ—এসবই নির্বাচনী পরিবেশকে সরাসরি প্রভাবিত করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই প্রভাব কেবল ভোটের দিনেই সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব ধীরে ধীরে ভোটারদের মনস্তত্ত্বে, নির্বাচনী প্রচারণায়, নিরাপত্তার ওপর আস্থা তৈরিতে এবং ভোটগ্রহণের বৈধতা-সংক্রান্ত বিতর্কেও গভীরভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে কোনো ওঠানামা নির্বাচনের ফলাফলেই নয়, বরং নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতাতেও প্রভাব ফেলে।
সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, দলীয় সংঘর্ষ, কর্মসূচি পালনের সময়ে হঠাৎ সহিংসতা, এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন দলের সংঘর্ষের ঘটনা সাধারণ ভোটারের মনে এক ধরনের ভীতি তৈরি করে। ভোটাররা নিরাপদ পরিবেশ ছাড়া ভোটকেন্দ্রে আসতে অনিচ্ছুক। ফলে নির্বাচনের গণতান্ত্রিক শক্তিমত্তা ক্ষুণ্ণ হয় এবং ভোটাধিকার প্রয়োগে অনীহা বাড়ে। ভয়-ভীতির কারণে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতির হার কমে গেলে নির্বাচনের ফলাফল আর যথাযথ প্রতিনিধিত্বের দাবি রাখতে পারে না। বিশেষ করে তরুণ ভোটার এবং নারী ভোটারদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা একটি প্রধান ফ্যাক্টর; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নড়বড়ে হলে তারা অনেক সময় ভোটের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে দেশের নির্বাচন যে কেবল নিরাপদ হওয়া দরকার তাই নয়, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই একটি স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিবেশ অপরিহার্য।
নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রেও বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গভীর প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিক পরিবেশে প্রচারণা চালাতে পারলে তবেই তারা জনগণের কাছে নিজেদের অবস্থান, নীতি, পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি তুলে ধরতে পারে। কিন্তু যদি সহিংসতার ঝুঁকি থাকে, তবে সভা-সমাবেশে উপস্থিতি কমে যায়, দলগুলো প্রচারণায় সীমাবদ্ধতা অনুভব করে, আর জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ কমে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বড় দলগুলো সরকারি বা প্রশাসনিক সুবিধা পেলে তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধা ভোগ করতে পারে, আর ছোট দলগুলো সমান প্রতিযোগিতার সুযোগ হারায়। ফলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, যা গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার মূল ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হলে প্রশাসনিক কাজেও চাপ সৃষ্টি হয়। নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মাঠ প্রশাসনকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হয় এবং তাদের ওপর চাপও বেড়ে যায়। নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তাদের সঠিকভাবে কাজ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু অতিরিক্ত উত্তেজনা ও সংঘর্ষের পরিবেশে তাদের কাজের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। কখনো প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক চাপ বা অভিযানের অভিযোগ ওঠে, কখনো আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ সৃষ্টি হয়। এসব বিতর্ক নির্বাচনী ফলাফল নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করে এবং জনগণের আস্থা নষ্ট করে। একটি নির্বাচনের সফলতা শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর নয়, বরং নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার ওপরও নির্ভর করে। যদি জনগণ মনে করে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ নয়, তবে তাদের আচরণ ভোটের দিনে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সিদ্ধান্তকেও প্রভাবিত করে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। যেকোনো ছোট ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক সময় অতিরঞ্জিত বা বিভ্রান্তিকর তথ্যও মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি করে। ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকের লাইভ ভিডিও, গুজব, সন্দেহজনক পোস্ট—সবই সাধারণ মানুষের মনে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দেয়। নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি যখন ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে পড়ে, এর প্রভাব সরাসরি বাস্তব ভোটদানে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হলে এ ধরনের গুজব আরও দ্রুত ছড়ায় এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করে। ফলে নির্বাচন নিয়ে মানুষের আস্থা কমে এবং গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ে।
এছাড়া অর্থনৈতিক প্রভাবও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা নিরাপত্তাজনিত সংকটের কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পরিবহন খাত, শ্রমজীবী মানুষের কাজকর্ম—সবকিছুই ব্যাহত হয়। ভোটারদের বড় একটি অংশ পেশাগত কারণে ভোরবেলা থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকেন। যদি তারা মনে করেন ভোট দিতে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, অথবা সহিংসতার কারণে পরিবহন ব্যবস্থা অচল হতে পারে, তবে তারা ভোট দিতে না যাওয়াই স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে; রাজনৈতিক সহিংসতা সেই অনিশ্চয়তাকে আরও গভীর করে তোলে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হলে আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচনের স্বচ্ছতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। একটি দেশের জন্য নির্বাচন শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যু নয়; এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না থাকলে নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলগুলো তাদের প্রতিবেদনেও নেতিবাচক মন্তব্য করে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের গণতান্ত্রিক ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এমনও দেখা গেছে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হলে নির্বাচনের দিন প্রশাসন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা কখনো কখনো ভোটারদের মনে ভয় সৃষ্টি করে। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী বা কঠোর নজরদারি অনেক সময় প্রয়োজন হলেও ভোটারদের মনস্তত্ত্বে তা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে ভোটের দিনটা হওয়া উচিত উৎসবমুখর, কিন্তু অতিরিক্ত নিরাপত্তার চেহারা অনেক সময় উৎসবের পরিবর্তে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে।
নির্বাচনী সহিংসতা শুধু ভোটগ্রহণের দিনেই ঘটে না; প্রার্থী মনোনয়ন, প্রচারণা, কিংবা ফলাফল ঘোষণার পরেও সহিংস ঘটনা ঘটে। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এসব সম্ভাবনা আরও বেশি। নির্বাচনের পর ফলাফল নিয়ে অসন্তোষ থেকে সহিংসতার ঝুঁকি থাকে, যার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা এবং নিরপেক্ষ আচরণ বিশেষভাবে নির্ভর করে। যদি নির্বাচনের আগে থেকেই সহিংসতার নজির থাকে, তবে পরবর্তী সময়ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যায়। ফলাফল ঘোষণার পর অস্থিরতা দেশের অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতি ও রাজনৈতিক পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উত্তেজনা যত বাড়ে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তত জটিল হয়। একদিকে দলগুলোর নিজেদের প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার চ্যালেঞ্জ—এ দুয়ের সংঘর্ষে সাধারণ ভোটার সবসময় দুর্বল অবস্থানে থাকে। ভোটারদের মনস্তত্ত্বে যখন ভয় তৈরি হয় যে সহিংস সংঘর্ষে তাদের জীবন বা সম্পদ ঝুঁকিতে পড়তে পারে, তখন গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ কমে যায়। এর ফলে দেশ যে স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির দিকে এগোতে চায়, সেই পথেই অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
একটি দেশের নির্বাচন কতটা সফল হবে তা নির্ভর করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা স্থিতিশীল তার ওপর। বর্তমান পরিস্থিতি যতই উত্তপ্ত থাকুক, তার মধ্যেই প্রশাসনের ওপর দায়িত্ব থাকে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে এবং জনগণের কাছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, তবে সহিংসতা বা অস্থিরতার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। ভোটারদের মনেও আস্থা ফিরে আসে, তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত হয় এবং নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়।
পরিশেষে বলা যায়, দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনকে নানা দিক থেকে প্রভাবিত করবে—ভোটারের মানসিকতা, রাজনৈতিক উত্তাপ, প্রশাসনের কার্যকারিতা, আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন, এমনকি নির্বাচনের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপরও। একটি স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিবেশ ছাড়া কোনো নির্বাচনই জনগণের সত্যিকারের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না। তাই নির্বাচনকে সফল ও বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং জনগণ—সবাইকে মিলেই একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনের মূল শক্তি জনগণ, আর জনগণের নিরাপত্তা ও আস্থাই একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভিত্তি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সেই ভিত্তিকে শক্তিশালীও করতে পারে, আবার দুর্বলও করে দিতে পারে—কীভাবে তা ব্যবহার করা হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
আপনার মতামত জানানঃ