
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এমন এক সেতুবিন্দুতে দাঁড়িয়ে, যেখানে তরুণদের মনোভাব ও পছন্দ–অপছন্দ ভবিষ্যতের পথনকশা অনেকটাই নির্ধারণ করে দেবে। ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী এই তরুণ প্রজন্ম একদিকে সংখ্যায় অনেক, অন্যদিকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলন, সরকার পরিবর্তন, সহিংসতা ও অনিশ্চয়তার অভিজ্ঞতা তাঁদের রাজনীতিবোধকে নতুন করে গড়ে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারের (বিওয়াইএলসি) সাম্প্রতিক এক জরিপ তরুণদের রাজনৈতিক ঝোঁক, দ্বিধা ও হিসাব–নিকাশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে, যা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনী রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে এক ধরণের বারোমিটার হিসেবে কাজ করতে পারে।
বিওয়াইএলসি ১০ থেকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে সারা দেশের ২,৫৪৫ জন তরুণের ওপর এই জরিপ চালিয়েছে। ইংরেজি, বাংলা ও মাদ্রাসা—তিন ধরনের শিক্ষা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থী ও তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে ভৌগোলিক ও সামাজিক বৈচিত্র্য অন্তত কিছুটা প্রতিফলিত হয়। র্যান্ডম স্যাম্পলিংয়ের মাধ্যমে নমুনা বাছাই করা হলেও বাংলাদেশে জরিপ নিয়ে যে চিরাচরিত সন্দেহ, তা এই জরিপকেও ছাড়েনি। অনেকে মনে করেন, হাজার দু’য়েক মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের রাজনৈতিক বাস্তবতা আঁকা যায় না। আবার অনেকে বলেন, মানুষ অনেক সময় খোলাখুলিভাবে নিজের প্রকৃত রাজনৈতিক পছন্দ বলতে চায় না। এসব আপত্তি যুক্তিসংগত হলেও, একের পর এক নানা প্রতিষ্ঠানের জরিপ যদি ধারাবাহিকভাবে কাছাকাছি ছবি দেখায়, তখন তা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করাও কঠিন হয়ে পড়ে। পূর্ণ সত্য না হোক, ‘সত্যের খুব কাছাকাছি’ কিছু ইঙ্গিত তো এসব জরিপ থেকে পাওয়া যায়ই।
এই জরিপের ফল দেখায়, বাংলাদেশের যুব সমাজ রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেনি; বরং ভোট দেওয়ার ইচ্ছা বরং প্রবল। অংশগ্রহণকারীদের ৯০ শতাংশই বলেছেন, তাঁরা নিবন্ধিত ভোটার, আর তাঁদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে চান। গত কয়েক বছরের একের পর এক নির্বাচনী বিতর্ক, ভোটাধিকার নিয়ে আন্দোলন, নিরাপত্তাহীনতা—সবকিছুর পরও যখন এত বড় অংশের তরুণ ভোট দেওয়ার আগ্রহ জানায়, তখন বোঝা যায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের বিশ্বাস পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। যদিও বাস্তবে ভোটের দিনে অংশগ্রহণের হার ঠিক কত হবে, তা দেখা বাকি; তারপরও জরিপের এই ইঙ্গিতকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।
সবচেয়ে আলোচিত অংশটি অবশ্য দলভিত্তিক সমর্থনকে ঘিরে। জরিপে দেখা গেছে, শীর্ষ অবস্থানের জন্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী একপ্রকার সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। বিএনপিকে সমর্থনের হার ২০ শতাংশ, আর জামায়াতের ১৭ শতাংশ; কাগজে-কলমে বিএনপি ৩ পয়েন্টে এগিয়ে। কিন্তু যেকোনো জরিপের মতো এখানেও ‘মার্জিন অব এরর’ বা সম্ভাব্য ভুলের সীমা রয়েছে; ফলে এই সামান্য ব্যবধান বাস্তবতায় মিলিয়ে যেতে পারে। মাঠের রাজনীতিতে দুই দলকে তাই প্রায় সমানে সমান ধরা যায়। আঞ্চলিক চিত্রে অবশ্য খানিক পার্থক্য আছে—চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহীতে বিএনপি তুলনামূলক বেশি এগিয়ে, কিন্তু খুলনা অঞ্চলে জামায়াত বেশি প্রভাবশালী বলে জরিপে উঠে এসেছে।
এখানে আরেকটি দিক গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াতের অবস্থান অনেক বিশ্লেষকের কাছে বিস্ময়কর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান, যুদ্ধাপরাধের দায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার—সব মিলিয়ে যে সামাজিক অবিশ্বাস ও বদনাম তাদের ঘিরে ছিল, তা হয়তো তরুণ প্রজন্মের একটি অংশের চোখে ম্লান হয়ে এসেছে। নিজেদের ‘মধ্যপন্থী’ ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পুনর্গঠনের চেষ্টা তারা দীর্ঘদিন ধরে করছে, এবং সে প্রচেষ্টার কিছুটা প্রতিফলন হয়তো এই ১৭ শতাংশ সমর্থনে দেখা যাচ্ছে। তবে এই সমর্থন এখনো মোট ভোটারের বিচারে অতি শক্তিশালী জনসমর্থন নয়, বরং এক ধরনের পুনরুজ্জীবনের ইঙ্গিত মাত্র।
অন্যদিকে বিএনপির জন্য ২০ শতাংশ সমর্থন অনেকের কাছে প্রত্যাশার তুলনায় কম। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধারণা ছিল, বিরোধী প্রথাগত শক্তি হিসেবে বিএনপি হয়তো বড় ধরনের জনসমর্থন পাবে। অনেক জরিপ ও বিশ্লেষণে আগেও দেখা গেছে, জাতীয় ভোটে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ভোট বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত। আওয়ামী লীগের প্রতি অসন্তোষ, স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগ—এসবের কারণে বিএনপির সমর্থন আরও বেড়ে গেছে, এমন ধারণাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু যখন মাঠ থেকে সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্রটি সরে যায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন বিএনপি নিজেও এক নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়েছে—সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত জামায়াতের সঙ্গে, এবং সেই লড়াই এখনো নিরঙ্কুশভাবে কেউ জেতেনি।
এ অবস্থার মধ্যে জরিপের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ফল হলো—তরুণদের একাংশ এখনো আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে। সব মিলিয়ে ১০ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, তাঁরা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে চান। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভিন্নমত দমনের অভিযোগ, নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক, ২০২৪ সালের সহিংসতা ও পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার মতো বড় ঘটনা সত্ত্বেও এই সমর্থন পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। জরিপটি আবার সেই রায় ঘোষণার আগেই করা হয়েছে। তারপরও যা বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের একধরনের ‘কোর ভোট ব্যাংক’ এখনো ধরে আছে, যারা রাজনৈতিক ঝড়ঝাপটার পরও দলটির পক্ষে অবস্থান বদলাতে রাজি হয়নি। এটা হয়তো সংগঠনগত শিকড়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক আবেগ বা ব্যক্তিগত–পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয়ের মিশ্রণ থেকেও আসতে পারে।
২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় আলোচনায় আসা ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি (এনসিপি)–র অবস্থান এই জরিপে তুলনামূলকভাবে বেশ দুর্বল। তরুণদের জন্য তরুণদের দল হিসেবে নিজেদের তুলে ধরলেও এই জরিপে এনসিপির সমর্থন মাত্র ৪ শতাংশ। আন্দোলনের উত্তাপ, নেতৃত্বের প্রতীকী আবেদন, সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয়তা—এসবের বাইরে গিয়ে যখন ভোটের রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়ায়, তখন দেখা যায় সংগঠনগত কাঠামো ও মাঠপর্যায়ের উপস্থিতি ছাড়া শুধু আবেগ দিয়ে সমর্থন ধরে রাখা কঠিন। তরুণদের একটি অংশ এই দলকে এখনো আগ্রহের চোখে দেখলেও বৃহৎ পরিসরে তা উল্লেখযোগ্য শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি—এটাই ইঙ্গিত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি হলো সিদ্ধান্তহীন ও নীরব ভোটারদের বড় অংশ। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের প্রায় ৩০ শতাংশ এখনো কোনো দলকে বেছে নেয়নি বলেছেন। নির্বাচনের আগে আগে এই ভোটগুলো কোনদিকে সরে যাবে, তা-ই মূল প্রশ্ন। এই ‘ফ্লোটিং ভোটার’ বা ভাসমান ভোটাররা শেষ মুহূর্তে সামান্য কিছু ঘটনা, প্রচার, প্রার্থীচয়ন বা রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে বড় ধাক্কা দিতে পারে যে কোনো দলকে। তাঁর পাশাপাশি আরও ১৮ শতাংশ তরুণ তাদের পছন্দ প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই নীরবতার ভেতরেও রাজনীতি আছে। অনেকেই ধারণা করছেন, এই অংশের ভেতরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ‘সাইলেন্ট’ আওয়ামী লীগ সমর্থক থাকতে পারেন, যারা বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে নিজের রাজনৈতিক পছন্দ বলতে চান না। যদি আনুমানিকভাবে ধরা হয়, এই ১৮ শতাংশের অর্ধেক আওয়ামী লীগপন্থী, তাহলে দলের প্রকৃত সমর্থন ১০ থেকে বেড়ে প্রায় ১৯ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে—যা বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থনের কাছাকাছি।
তবে বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থন একত্রে বিবেচনা করলে (২০ + ১৭ = ৩৭ শতাংশ) স্পষ্ট হয়, আওয়ামী লীগের অবস্থান এখনো তাদের নিচে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ ব্যবস্থা যেখানে যে আসনে যে প্রার্থী বেশি ভোট পায়, সে-ই বিজয়ী—এমন বাস্তবতায় শতাংশের সরল যোগ-বিয়োগ দিয়ে ফল নির্ধারণ করা যায় না। কোন দলের ভোট কোথায় কতটা ছড়িয়ে আছে, কোন অঞ্চলে কতটা ঘনীভূত—এসব উপাদান বরং অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তাহলে তাদের সাবেক ভোটাররা কার দিকে ঝুঁকতে পারেন? জরিপ অনুযায়ী, এ ধরনের সাবেক আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ৫৬ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা ভোট দেবেনই না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে এমন বড় অংশের বিমুখ হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য একটি উদ্বেগজনক সংকেত। যারা ভোট দিতে চান, তাঁদের মধ্যে কেউ ভোট সরিয়ে দিচ্ছেন বিএনপি বা জামায়াতের দিকে, আবার অনেকেই এখনো সিদ্ধান্তহীন। আশ্চর্যের বিষয়, ঐতিহাসিকভাবে যার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে তীব্র আদর্শিক দ্বন্দ্ব, সেই জামায়াতকেও কিছু সাবেক আওয়ামী লীগ ভোটার বিকল্প হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন। এর পেছনে একদিকে আছে মাঠপর্যায়ে বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা কঠোর আচরণের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে আছে রাজনৈতিক ক্যালকুলেশন—জামায়াত ক্ষমতায় এলেই হয়তো প্রমাণ হবে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে ঠেকানোতে আওয়ামী লীগই ছিল শেষ ‘বালু বাঁধ’; এই যুক্তি অনেকের কাছে আত্মতুষ্টির এক ধরনের রাজনৈতিক সান্ত্বনাও হতে পারে।
সব মিলিয়ে বিওয়াইএলসির এই যুব জরিপ যে ছবি তুলে ধরে, তা হলো: বিএনপি ও জামায়াত এখন তরুণদের মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় কাছাকাছি অবস্থানে, কিন্তু কেউই নিরঙ্কুশভাবে এগিয়ে যেতে পারেনি। আওয়ামী লীগের এক ধরনের স্থায়ী সমর্থন এখনো টিকে আছে, যদিও তা আগের মতো প্রভাবশালী নয়। নতুন প্রজন্মের দল হিসেবে যে এনসিপি নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছিল, মাঠের বাস্তবতায় তারা এখনো প্রান্তিক শক্তি। সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে পারে সেই ৩০ শতাংশ সিদ্ধান্তহীন এবং ১৮ শতাংশ নীরব ভোটারদের একটি বড় অংশ—যাদের ভোট শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যাবে, তা নির্ধারণ করবে আগামী নির্বাচন, এবং অনেকাংশে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক মানচিত্রও।
এই জরিপ কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নয়; বরং এটি বর্তমান মুহূর্তের একটি ‘স্ন্যাপশট’। রাজনৈতিক ঘটনা, অভিযুক্তদের বিচার, জোট–সমীকরণ, নির্বাচনী প্রচার, সহিংসতা বা সহনশীলতা—সবকিছু মিলিয়ে আগামী কয়েক মাসে এই ছবি আমূল বদলাতেও পারে। তবু একে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার অবকাশ নেই। কারণ এটি স্পষ্টভাবে আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাংলাদেশের তরুণ ভোটাররা এখনো রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, কিন্তু নিরঙ্কুশভাবে কোনো একক পক্ষের পক্ষে ঝুঁকে নেই। আর সে জন্যই বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো খোলা—তার গন্তব্য নির্ধারণের চাবিকাঠি রয়ে গেছে তরুণদের হাতে, তাঁদের ভয়, আশা, স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষার জটিল সমীকরণের ভেতর।
আপনার মতামত জানানঃ