বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা, শাসনব্যবস্থায় চাপ, প্রশাসনের পেশাগত নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক—এসব যেন নতুন নয়। কিন্তু সম্প্রতি চট্টগ্রামে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্য সেই পুরোনো বিতর্ককে আরও তীব্র, আরও স্পষ্ট করে সামনে এনেছে। নির্বাচনী দায়িত্বশীলদের উদ্দেশ্যে দেওয়া তাঁর বক্তব্যে যে মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তা শুধু একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ নির্দেশনা নয়; বরং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীরভাবে ঠাঁই নেওয়া কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার প্রবণতার নগ্ন প্রতিফলন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তেই ভাইরাল হওয়া তাঁর বক্তব্য নতুন করে প্রশ্ন তুলছে—বাংলাদেশ কি আবারও শোষণ-নির্ভর, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতির পথে হাঁটছে, নাকি এ পথ থেকে বেরিয়ে আসার সত্যিকারের প্রয়াস এখনো শুরুই হয়নি?
চট্টগ্রাম জিইসি কনভেনশন হলে আয়োজিত জামায়াতের ‘নির্বাচনী দায়িত্বশীল সম্মেলন’-এ শাহজাহান চৌধুরী যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা যেন খুলে দিয়েছে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার আড়ালে থাকা আরেক স্তরের বাস্তবতা। তিনি শুধু নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেননি; বরং স্পষ্টভাবেই বলেছেন—জনগণই কেবল নির্বাচন নির্ধারণ করবে না, প্রশাসনকেও “আমাদের আন্ডারে” নিয়ে আসতে হবে। তাঁর ভাষায়, “আমাদের কথায় উঠবে, আমাদের কথায় বসবে, আমাদের কথায় গ্রেপ্তার করবে, আমাদের কথায় মামলা করবে।” এই একটি বাক্যই দেশের গণতান্ত্রিক চর্চায় বহুদিনের সঞ্চিত ক্ষতকে তাজা করে তুলেছে। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুলিশ, প্রশাসন, শিক্ষক বা সরকারি কর্মকর্তা কারওই কোনো রাজনৈতিক নেতা বা দলের ‘আন্ডারে’ থাকার কথা নয়। তারা প্রতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, আইনের সেবক, জনগণের অধিকার রক্ষাকারী। সেখানে একজন রাজনৈতিক নেতার এমন দাবি শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনই নয়, রাজনৈতিক নৈতিকতা ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রতি সরাসরি হুমকি।
এই বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশও সমানভাবে উদ্বেগজনক। তিনি বলেছেন, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক থেকে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত সবার দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে কথা বলা উচিত। পুলিশ ওসি থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসনকে প্রতিদিন প্রোগ্রামের খবর নিয়ে প্রটোকল দিতে হবে। এই কথাগুলো শুধু দলীয় প্রভাব বিস্তারের ইঙ্গিত নয়, বরং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের এক সর্বব্যাপী নকশা যা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে দলীয় আনুগত্যকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর আরোপ করতে চায়।
এমন বক্তব্য কেন এত বড় উদ্বেগের জন্ম দেয়, তা বুঝতে হলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস একটু খুলে দেখতে হয়। বিগত দশকগুলোতে বিভিন্ন সময়েই শাসকদল বা বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক মনোভাবের মধ্যে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করার আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করা গেছে। নির্বাচন এলেই দেশে একটি বিশেষ চিন্তা কাজ করে—যে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে-ই রাজনৈতিক সুবিধা পায়। এ কারণে নির্বাচনপূর্ব সময়ে সরকারি চাকরিজীবীদের ওপর দলীয় চাপ, আইনের প্রয়োগে বৈষম্য, পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ নিয়মিতই ওঠে। শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্য সেই একই পরিচিত প্রবণতার পুনরাবৃত্তি, তবে আরও স্পষ্ট, আরও নগ্নভাবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার মূল কারণ হলো, এটি শুধু একটি দলের ভাষা নয়; বরং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক গভীর সংকটকে প্রকাশ করে। বহু রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে প্রশাসনকে নিজের মত করে সাজাতে চেয়েছে, আর ক্ষমতার বাইরে থাকলে আবার সেই প্রশাসনের ‘নিরপেক্ষতা’ দাবি করেছে। ফলে প্রশাসনিক কাঠামোতে একটি দ্বৈতচাপ সৃষ্টি হয়েছে—যেখানে সৎ ও আদর্শবান কর্মকর্তা রাজনৈতিক ক্ষমতার হুমকি অথবা চাকরির অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন। এই সংস্কৃতি শুধু প্রশাসনের পেশাদারিত্বকেই নষ্ট করে না; বরং দুর্নীতি, পক্ষপাত, এবং আইনের অপব্যবহারের পথও প্রশস্ত করে।
জামায়াতের এই বক্তব্য বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে কারণ দলটি অতীতে নিষিদ্ধ কার্যক্রমে অভিযুক্ত, এবং বর্তমানে নির্বাচন নিয়েও নানা বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে। একটি দল যাদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রশ্ন রয়েছে, তারা যখন প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণের সরাসরি দাবি তোলে, তখন সেটি জাতীয় নিরাপত্তা, আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ—তিন ক্ষেত্রেই উদ্বেগ তৈরি করে। প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা কখনোই রাজনৈতিক পরিপক্বতার লক্ষণ নয়; বরং এটি স্বৈরতন্ত্রের পূর্বাভাস।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্নীতি এক ধরনের কাঠামোগত সংস্কৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময়ই জনমতের শক্তির চেয়ে প্রশাসনিক ক্ষমতার ওপর বেশি নির্ভর করতে চায়। ফলে পুলিশি ক্ষমতা, সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়ন্ত্রণ, মামলা-হয়রানি—এসবকে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্য ঠিক এই মানসিকতারই প্রতিফলন, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু জনগণ নয়, বরং প্রশাসনিক যন্ত্র।
একটি সুস্থ গণতন্ত্র কর্মসূচি, যুক্তি, নীতি, পরিকল্পনা এবং জনসমর্থনের ওপর দাঁড়ায়। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করে উন্নয়ন, ন্যায়বিচার এবং সুশাসনের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে। কিন্তু যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা জনগণকে পাশ কাটিয়ে প্রশাসনকে আনুগত্যের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের কথা বলে, তাহলে সেটি গণতন্ত্র নয়—বরং রাজনৈতিক দখলদারিত্বের চিন্তা। এর ফলে ভোটাররা দুর্বল হয়ে পড়ে, আইনের শাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়।
এই বক্তব্যের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, এটি ভবিষ্যৎ নির্বাচনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। যদি নির্বাচনী এলাকায় শিক্ষক, প্রশাসন, পুলিশ সবাই একদলীয় নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে ভোটার কি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবেন? নির্বাচনের ফলাফল কি প্রকৃত সংখ্যা প্রতিফলিত করবে? নাকি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকবে? এসব প্রশ্নই উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এজন্য একটি সংবেদনশীল অবস্থায় দাঁড়িয়ে। প্রশাসন নিয়ে এমন দৃষ্টিভঙ্গি শুধু অন্যায় নয়; এটি রাষ্ট্রের পবিত্রতম প্রতিষ্ঠানগুলোকে পক্ষপাতের দিকে ঠেলে দেয়। এরপর দুর্নীতি আর অন্যায়ের জন্য আর আলাদা পথ লাগে না—ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় সেগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে ওঠে। শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্য তাই কেবল একটি বক্তব্য নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কোন পথে যাচ্ছে তার স্পষ্ট সংকেত।
গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম দায়িত্ব প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থ থেকে মুক্ত রাখা। নির্বাচন যেন নির্বাচনের মতো হয়—যেখানে ভোটারই সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সংস্কার, যেখানে প্রশাসন হবে নিরপেক্ষ, শিক্ষক হবেন জাতির বিবেক, আর পুলিশ হবে আইনের রক্ষক—কোনো দলের নয়। শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্য সেই প্রয়োজনীয় সংস্কারের ঘাটতিকে আরও উন্মোচিত করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের বক্তব্য শুধু নিন্দা না কি আইনগত তদন্তের বিষয় হওয়া উচিত? বিশেষত যখন নির্বাচন আসন্ন, তখন রাষ্ট্র কি এই ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণমুখী বক্তব্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে? নাকি রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে এই কথাগুলোও ভুলে যাওয়া হবে? সঠিক পথনির্দেশের জন্য প্রয়োজন নীতি, সততা এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রকৃত অঙ্গীকার—যা এখনো অনেকটাই অনুপস্থিত।
বাংলাদেশ কি আবারও শোষণ আর দুর্নীতির পথে হাঁটবে, নাকি ভেঙে ফেলবে এই চক্র? শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্য হয়তো সেই প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিয়ে দিয়েছে—এখন প্রয়োজন রাষ্ট্র আর সমাজ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে তার বিপরীত পথ খোঁজার।
আপনার মতামত জানানঃ