বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সম্প্রতি ধর্ম নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “ভোট দিলে জান্নাত” – এই ধরনের প্রচারণা আসলে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা এবং ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের এক জঘন্য উদাহরণ। রিজভীর মতে, এই ধরনের বক্তব্য ইসলামের মৌলিক নীতির পরিপন্থী এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে বিকৃত করার শামিল।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। তিনি অভিযোগ করেন, কিছু ভ্রান্ত মানুষ ইসলামের নাম ব্যবহার করে সমাজকে ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে। ধর্মকে বিকৃত করে তারা রাজনৈতিক লাভ হাসিল করতে চায়। তিনি প্রশ্ন করেন, “জামায়াতে ইসলামী কি এখন মধ্যযুগীয় খ্রিষ্টান পাদরিদের মতো জান্নাতের টিকিট বিক্রি করছে?”
রিজভী বলেন, জামায়াতের নেতাকর্মীরা নাকি জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালাচ্ছে যে দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। এ ধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ ধর্মবিরোধী এবং ইসলাম কখনোই এই ভণ্ডামিকে সমর্থন করে না। তিনি মনে করেন, ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার এই প্রবণতা সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তার অভিযোগ, জামায়াত এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা, কটূক্তি ও অপপ্রচার ছড়ানোর জন্য তারা একটি গোষ্ঠী গঠন করেছে। “এই তরুণদের দিয়ে তারা মিথ্যাকে সাজিয়ে এমনভাবে প্রচার করছে যেন তা সত্য বলে মনে হয়,” বলেন তিনি।
রিজভীর দাবি, যারা নভেম্বরে গণভোটের কথা বলছে, তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করা। তিনি বলেন, জামায়াতের এসব প্রচারণা ও পরিকল্পনার পেছনে রাজনৈতিক চাতুর্য রয়েছে। “তারা একদিকে সংস্কার, গণভোট, পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) নিয়ে বিতর্ক তৈরি করছে, অন্যদিকে ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগিয়ে ভোট টানার চেষ্টা করছে,” বলেন রিজভী।
তার মতে, জামায়াত এখনো আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থাকতে চায় এবং ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্য নানা কৌশল নিচ্ছে। “তাদের এই রাজনৈতিক চালচলন থেকেই বোঝা যায়, তারা এখনও পুরোনো অভ্যাস ছাড়েনি,” মন্তব্য করেন তিনি।
রিজভী আরও বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে “নতুন ইসলামিক ধারা”র নামে বিভ্রান্তিকর মতাদর্শ ছড়ানোর চেষ্টা চলছে, যাকে তিনি “মওদুদীবাদ” বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ এই মতবাদকে কোনোদিনই গ্রহণ করবে না, কারণ এটি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। “আমাদের ঈমান, আকিদা ও তাওহীদের ভিত্তিতে এই ধরনের চিন্তাধারার কোনো স্থান নেই,” বলেন রিজভী।
তিনি ১৯৭১ সালের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “যারা তখন নৃশংসতা চালিয়েছিল, তারাও তো মুসলমান ছিল। কিন্তু একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের ওপর কীভাবে এমন নির্দয়তা চালাতে পারে?” রিজভীর মতে, যারা সেই অপরাধগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল বা এখনো করে যাচ্ছে, তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের অনুসারী নয়। তাদের অতীত অন্যায়কে ভুলে গিয়ে এখন ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা কোনোভাবেই ইসলামের শিক্ষা নয়।
তিনি বলেন, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় তারা নীরব ছিল। এখন সেই একই দল অন্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছে। “কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ এখন অনেক সচেতন; তারা বুঝে ফেলেছে কারা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করছে,” বলেন রিজভী।
তিনি সতর্ক করেন যে ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করলে তা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করবে, মানুষকে বিভ্রান্ত করবে এবং জাতীয় ঐক্য নষ্ট করবে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হলো ন্যায়, সহনশীলতা ও মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া—কিন্তু জামায়াতের মতো দলগুলো তা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলহাজ মাওলানা মো. আলমগীর হোসাইন। এ সময় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জামাল, সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক এ টি এম আবদুল বারী ড্যানী এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য মাওলানা শাহ মো. নেছারুল হকও বক্তব্য দেন।
তারা সবাই বলেন, ধর্ম কখনোই রাজনীতির হাতিয়ার হতে পারে না। ইসলামের নাম ব্যবহার করে মানুষকে প্রতারিত করা সবচেয়ে বড় অপরাধ। তারা মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান—ধর্মের নামে মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত না হতে, বরং সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে।
সভায় উপস্থিত বক্তারা মনে করেন, বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মের অপব্যবহার বেড়ে গেছে। কেউ কেউ ধর্মকে আবেগের হাতিয়ার বানিয়ে জনগণের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করছে। এতে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে এবং প্রকৃত ইসলামি মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। তারা বলেন, ইসলাম শান্তি, সত্য ও সহনশীলতার ধর্ম—কোনো রাজনৈতিক ফায়দার মাধ্যম নয়।
রিজভীর বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে, বিএনপি ধর্মের অপব্যবহারকে রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে ভুল মনে করে। তিনি ইসলামের নামে যেকোনো ধরনের মিথ্যা প্রচারণা বা প্রতারণাকে কঠোরভাবে প্রতিহত করার আহ্বান জানান। তার মতে, একটি সুস্থ সমাজ গড়তে হলে ধর্মকে তার নিজস্ব মর্যাদায় রাখতে হবে, রাজনীতির অংশ হিসেবে নয়।
তার বক্তব্য শেষ করে তিনি বলেন, “আমরা চাই—বাংলাদেশে ইসলাম থাকবে তার মূল শিক্ষা অনুযায়ী: সত্য, মানবতা ও ন্যায়ের পথে। কিন্তু যারা ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে, তাদের মুখোশ এখন জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।”
সার্বিকভাবে রিজভীর বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে এক ধরনের সতর্কবার্তা—যদি ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা চলতেই থাকে, তবে সমাজের শান্তি, ঐক্য ও নৈতিকতা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধর্মের নামে বিভাজন নয়, বরং ঐক্য ও সত্যের প্রচারই আজ সময়ের দাবি।
আপনার মতামত জানানঃ