বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে এক অদ্ভুত দ্বৈত চিত্র দেখা যাচ্ছে। একদিকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য গোপন কৌশল ও ঝটিকা মিছিলের মতো কর্মসূচি অবলম্বন করছে, অন্যদিকে বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল এবং আরও কিছু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাজপথে সক্রিয় হয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। ২০২৫ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে দলটির জন্য এটি এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতারা বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছেন, আর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এখন তালাবদ্ধ। কিন্তু এর পরও ঢাকার রাজপথে এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঝটিকা মিছিল, গোপন সভা, হঠাৎ বিক্ষোভ ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
এই চিত্র বিশ্লেষকদের কাছে অচেনা নয়। কারণ আওয়ামী লীগের বর্তমান কৌশলগুলোর সঙ্গে অতীতে জামায়াতে ইসলামী যেভাবে দমন-পীড়নের মধ্যেও টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল, তার যথেষ্ট মিল পাওয়া যাচ্ছে। জামায়াতও একসময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে হঠাৎ মিছিল করত, কয়েক মিনিট স্লোগান দিয়ে দ্রুত ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত। একই সঙ্গে তারা একটি শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল যাতে নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট সময়ে কর্মীদের সক্রিয় করা যায়। আওয়ামী লীগও এখন অনেকটা একইভাবে তার নেতাকর্মীদের গোপনে সক্রিয় করছে, কোথায় কখন মিছিল হবে তা শেষ মুহূর্তে জানিয়ে দিচ্ছে এবং ঝটিকা কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি টিকিয়ে রাখছে।
এমন কৌশল কেন আওয়ামী লীগের জন্য প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বোঝা যায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে। সরকারের সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর দলটির রাজনীতি একেবারেই অন্ধকারে ঢেকে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের শেকড় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে, কোটি কোটি নেতাকর্মী এখনও সক্রিয়। তাদেরকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় রাখা সম্ভব নয়। ফলে দলটি টিকে থাকার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও গোপন কৌশল গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। যদিও সমালোচকেরা বলছেন, এভাবে রাজনীতি করলে আওয়ামী লীগ আরও বেশি গোপন সংগঠনে পরিণত হতে পারে এবং তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য শুভ হবে না।
অন্যদিকে, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে অন্যান্য দল। বিশেষত জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফতে মজলিস, নেজামে ইসলাম ও জাগপার মতো দলগুলো। তারা একসঙ্গে সমন্বিতভাবে না হলেও প্রায় একই ধরনের কর্মসূচি দিচ্ছে এবং একই সময়ে রাজপথে সক্রিয় হচ্ছে। তাদের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রবর্তন, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন এবং ক্ষমতাসীনদের বিচার নিশ্চিত করা। অনেক দল আবার প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা অনুপাতে ভোটব্যবস্থা চালুর পক্ষে মত দিয়েছে। ফলে দেশের রাজনীতিতে নতুন একটি সমীকরণ তৈরি হয়েছে যেখানে ইসলামপন্থী দলগুলো নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করছে এবং একই সঙ্গে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সঙ্গে তুলনা টেনে নিজেদের বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাগুলোও এই প্রেক্ষাপটকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে। কমিশন এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৩টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করেছে এবং বেশ কিছু অভিন্ন প্রস্তাব উঠেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি—এসব বিষয়ে অনেক দল একমত হয়েছে। তবে বাস্তবায়ন কিভাবে হবে, তা নিয়ে মতভেদ রয়ে গেছে। বিএনপি আপাতত সংঘাত এড়িয়ে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে মনোযোগী হতে চাইছে। তারা চাইছে কমিশনের আলোচনার মাধ্যমে একটি সর্বজনগ্রাহ্য রূপরেখা তৈরি হোক। কিন্তু অন্যদিকে ইসলামপন্থী ও ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলো মনে করছে রাজপথে চাপ সৃষ্টি না করলে সরকার বা কমিশন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেবে না।
এই দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বর্তমান কর্মকৌশল একধরনের সংকেত দিচ্ছে। দলটি সরাসরি রাজপথে নামতে পারছে না, কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রাখছে। এটি আওয়ামী লীগের জন্য যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও বটে। কারণ অতীতে জামায়াতের অভিজ্ঞতা বলে, দীর্ঘদিন গোপন রাজনীতি করলে সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে, ভেতরে ভাঙন সৃষ্টি হয় এবং নতুন প্রজন্মের কাছে দলটির গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। আওয়ামী লীগও যদি দীর্ঘ সময় এভাবে গোপন রাজনীতি চালাতে থাকে, তবে তা তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য ভালো সংকেত নাও হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এক বড় পরীক্ষা। একদিকে একটি প্রধানধারার দল নিষিদ্ধ হয়ে গোপনে সক্রিয় হচ্ছে, অন্যদিকে ইসলামপন্থী দলগুলো রাজপথে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এতে ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কাও বাড়ছে। বিশেষ করে বিদেশি শক্তির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব যেমন বলেছেন, আওয়ামী লীগের কর্মকৌশলের পেছনে বিদেশি প্রভাব থাকতে পারে। যদিও তা এখনই প্রমাণ করা সম্ভব নয়, তবে এই বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন জল্পনা-কল্পনা সৃষ্টি করেছে।
জনগণের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই রাজনৈতিক কৌশল ও পাল্টা কৌশলের শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যদি একটি কার্যকর সনদ তৈরি করতে পারে এবং সব দল তা মেনে নেয়, তাহলে হয়তো একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে এগোনো সম্ভব। কিন্তু যদি কমিশন ব্যর্থ হয় বা দলগুলো কেবল কৌশলগত কারণে আলোচনায় অংশ নেয়, তবে রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে।
আওয়ামী লীগের জন্য এটি এক কঠিন সময়। তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ, কিন্তু তাদের জনসমর্থন পুরোপুরি শেষ হয়নি। এ অবস্থায় দলটি যতই জামায়াতের মতো কৌশল অবলম্বন করুক না কেন, দীর্ঘমেয়াদে তাদেরকে নতুন কৌশল ভাবতে হবে। অন্যদিকে ইসলামপন্থী দলগুলো নিজেদের জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তারা কতটা গণগ্রহণযোগ্য হবে সেটি এখনো অনিশ্চিত। বিএনপি আপাতত অপেক্ষার কৌশল নিয়েছে, তবে পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে তা নির্ভর করছে কমিশনের কার্যক্রম এবং রাজপথের আন্দোলনের ওপর।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির এই পর্যায় একটি রূপান্তরের সময়। ক্ষমতার লড়াইয়ের পাশাপাশি এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও লড়াই। কে টিকে থাকবে, কে হারিয়ে যাবে, আর কে নতুন করে জায়গা তৈরি করবে—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ভর করছে আগামী কয়েক মাসের রাজনৈতিক পদক্ষেপের ওপর। জনগণও দেখছে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা চায় নাকি আবারও অস্থিরতার অন্ধকারে ঢুকে যাবে। এই মুহূর্তে ভবিষ্যৎ যেদিকেই যাক, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বড় মোড় হিসেবে বিবেচিত হবে।
আপনার মতামত জানানঃ