
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনের আগমন মানেই এক অস্থিরতা, উত্তেজনা ও নানা রকম আলোচনার জন্ম। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপি যখন তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে, তখন সেই তালিকার কয়েকজনের নাম ঘিরে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক—ঋণখেলাপি প্রার্থীদের অংশগ্রহণ নিয়ে। নির্বাচনের আইন অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার অন্তত সাত দিন আগে কোনো প্রার্থী যদি নিজের ঋণ নিয়মিত করতে না পারেন, তবে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য বলে গণ্য হবেন। এই আইনি বাস্তবতা সামনে রেখেই এখন বিএনপির কিছু প্রার্থী ঋণ নিয়মিত করার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭টি আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে অন্তত চারজন প্রার্থীর ব্যাপারে ব্যাংক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে তারা ঋণখেলাপি। পূর্ববর্তী নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অনেক প্রার্থী আদালতের স্থগিতাদেশ কিংবা তথ্য গোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণকে ‘নিয়মিত’ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তবে এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, কেউ আদালতের স্থগিতাদেশ পেলেও ঋণ তথ্য ব্যুরো (সিআইবি)-তে তাকে খেলাপি হিসেবেই চিহ্নিত করা হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এমন কেউ সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য থাকবেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খানও একই কথা বলেছেন। তাঁর মতে, বিধি অনুযায়ী ঋণখেলাপি, করখেলাপি বা বিলখেলাপি কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। ফলে মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীদের মধ্যে যাদের খেলাপি ঋণ রয়েছে, তাদের অবশ্যই নির্বাচনপূর্বে ঋণ নিয়মিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সাধারণত নির্বাচন সামনে এলেই প্রার্থীরা ঋণ নিয়মিত করার জন্য উদ্যোগী হন; এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী মনোনয়ন জমা দেওয়ার সাত দিন আগে পর্যন্ত যদি কোনো প্রার্থী ঋণ নিয়মিত করতে পারেন, তবে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কাউকে খেলাপি হিসেবে রিপোর্ট করে, তাহলে তাঁর প্রার্থীতা সরাসরি বাতিল করা হবে। আরও বলা হয়েছে, কেউ যদি নির্বাচিত হওয়ার পর মিথ্যা তথ্য দেন বা ঋণখেলাপি প্রমাণিত হন, তাঁর সংসদ সদস্যপদও বাতিল হবে।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির ঘোষিত প্রার্থীদের মধ্যে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে। যশোর-৪ (বাঘারপাড়া–অভয়নগর) আসনের প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার তালহা শাহরিয়ার আইয়ুব, যিনি কৃষক দলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, তাঁর বিরুদ্ধে চারটি ব্যাংকের প্রায় ১৩৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে। জানা যায়, ২০১৭ সালে তিনি সাইমেক্স লেদার প্রোডাক্টসের নামে ঢাকা ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখা থেকে ১৪টি ভুয়া এলসি খুলে ২১ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেন। ব্যাংকটি ২০১৯ সালে মামলা করে, আর সুদসহ এখন পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের এপ্রিলে ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত তাঁকে ও তাঁর স্ত্রী তানিয়া রহমানকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের পর তিনি মুক্তি পান। এদিকে, ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকে তাঁকে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে রিপোর্ট করেছে।
তাঁর প্রতিষ্ঠানটির স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় ৭০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। ব্যাংকটি এই ঋণ পুনঃতফসিল করতে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্টের শর্ত দেয়, কিন্তু আইয়ুব মাত্র ৬৫ লাখ টাকা জমা দেন, ফলে ঋণটি নিয়মিত হয়নি। জনতা ব্যাংকে তাঁর আরও ১১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আছে, এবং তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেক প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ব্যাংকেও প্রায় ১২ কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ী রয়েছে। ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁর মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। ঢাকা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকে তাঁর বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় শুনানি হয়েছে, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি।
গাজীপুর-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী শাহ রিয়াজুল হান্নান, প্রয়াত বিএনপি নেতা আ স ম হান্নান শাহর পুত্র। তিনি কাপাসিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক। তাঁর বিদেশি মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে তিন কোটি ২৪ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। ব্যাংকটি এই ঋণের বিপরীতে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে এবং ৩ নভেম্বর আদালতে শুনানিও হয়েছে। আদালত ব্যাংক ও প্রার্থীর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ঋণ পরিশোধের জন্য ১৫ দিনের সময় দিয়েছেন। ফলে এই সময়ের মধ্যে তিনি ঋণ নিয়মিত করতে পারলে প্রার্থী হিসেবে টিকে যেতে পারেন।
ঢাকা-১ (দোহার–নবাবগঞ্জ) আসনে বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আবু আশফাক, যিনি ঢাকা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক। তাঁর মালিকানাধীন খন্দকার কনস্ট্রাকশন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের কাছে ১৬ কোটি টাকার ঋণখেলাপি। জানা গেছে, তিনি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঋণ নিয়মিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। যদিও অন্য কোনো ব্যাংকে তাঁর আরও খেলাপি ঋণ রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আরও আলোচনায় রয়েছেন চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনের প্রার্থী সরওয়ার আলমগীর, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। তাঁর মালিকানাধীন এনএফজেড টেরি টেক্সটাইলের নামে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২০১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, তিনি উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন, ফলে আপাতত আইনি দিক থেকে খেলাপি হলেও কার্যত তিনি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সরওয়ার আলমগীর দাবি করেন, “আমি খেলাপি নই, ব্যবসা করছি নিয়ম মেনেই।” সাংবাদিকের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আপনি আরেক প্যাঁচালে ফেলছেন। আমি খেলাপি নই, আমার মতো করে ব্যবসা করছি।”
এই উদাহরণগুলো শুধু বিএনপির প্রার্থী তালিকার কিছু নাম, কিন্তু এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থিক সংস্কৃতির এক গভীর চিত্র তুলে ধরে। বড় দলগুলোর প্রার্থী বাছাইয়ে প্রায়ই দেখা যায় যে আর্থিক দায়দেনা, ঋণখেলাপি কিংবা করখেলাপির বিষয়গুলো উপেক্ষা করা হয়। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলেরা জনপ্রিয়তা, প্রভাব ও অর্থনৈতিক সক্ষমতাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। অথচ একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রার্থীর আর্থিক সচ্ছলতা নয়, নৈতিক যোগ্যতাই হওয়া উচিত প্রধান বিবেচ্য।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ইতোমধ্যেই উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১.৬ ট্রিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভূমিকা বড়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে ঋণগ্রহীতারা পুনঃতফসিলের সুবিধা পান, মামলা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর, এবং ব্যাংকগুলো আদায় করতে পারে না পাওনা টাকা। এই বাস্তবতার মধ্যেই যদি খেলাপি ঋণগ্রহীতারা সংসদে প্রবেশ করেন, তাহলে তা শুধু নৈতিক বিপর্যয় নয়, আর্থিক শৃঙ্খলারও গুরুতর ব্যত্যয় ঘটাবে।
এখন প্রশ্ন উঠছে—বিএনপি কি এই প্রেক্ষাপটে তাদের প্রার্থী বাছাইয়ে যথাযথ যাচাই-বাছাই করেছে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দলটি দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকায় মাঠপর্যায়ের কর্মী থেকে শুরু করে সম্ভাব্য প্রার্থীদের আর্থিক অবস্থা তেমনভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেনি। ফলে যাঁরা দলীয় অনুগত, যাঁদের সংগঠন পরিচালনায় প্রভাব রয়েছে, তাঁদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক হলেও নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
অন্যদিকে, বিএনপির এই প্রার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, তাদের বিরুদ্ধে থাকা ঋণ মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ক্ষমতাসীনদের চাপে ব্যাংকগুলো অনেক সময় মিথ্যা তথ্য দেয় বা মামলা করে, এমন অভিযোগ তাদের। তবে যেভাবেই হোক, নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান এবার বেশ কঠোর। সুতরাং আইনি দিক থেকে এদের মধ্যে অনেকেই শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে পারবেন না, যদি না সময়মতো ঋণ নিয়মিত করেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার। প্রার্থী ঘোষণার সময় দলগুলো যদি আর্থিক অনিয়মে জড়িতদের বাদ দিতে পারে, তবে জনগণের আস্থা বাড়বে। কারণ, সংসদ কেবল আইন প্রণয়নের স্থান নয়—এটি নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীকও বটে।
এবারের নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির প্রার্থী তালিকা তাই শুধু রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নয়, আর্থিক শুদ্ধতারও এক বড় পরীক্ষায় দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ নিয়ে যারা নির্বাচনে নামছেন, তাঁদের ভাগ্য নির্ভর করছে ব্যাংকের হিসাবখাত ও আদালতের রায়ের ওপর। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ একটাই প্রশ্ন করছে—যাঁরা নিজেদের ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি, তাঁরা কীভাবে কোটি কোটি মানুষের দায়িত্ব নিতে পারবেন?
আপনার মতামত জানানঃ