বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাসে নানা উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে বহু নেতা বিতর্ক, প্রশংসা, সমালোচনা এবং জনপ্রিয়তার বৃত্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে, তা নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ শুধু একটি রাজনৈতিক চরিত্রের বিচার নয়, বরং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার কোনো প্রধানমন্ত্রীর এমন রায়। দেশের রাজপথ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, প্রবাস, সংবাদমাধ্যম—সর্বত্রই এ রায়কে ঘিরে তুমুল আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক প্রতিশোধ, ন্যায়বিচার, মানবতাবিরোধী অপরাধ—সব প্রশ্নই ছুঁয়ে যাচ্ছে জনমানস। এই রায়ে যাঁদের কাছে আনন্দ নেই, তাঁদের কাছে ব্যথা আছে; আবার যাঁদের কাছে ব্যথা নেই, তাঁদের কাছে স্বস্তির নিঃশ্বাস আছে অতীতের কষ্টের স্মরণে। এক কথায়, শেখ হাসিনার রায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক মোড়।
লেখক মাহমুদুর রহমান মান্নার বিবৃতিতে প্রতিফলিত হয়েছে এক রাজনৈতিক প্রবীণ ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, আবেগ এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলার অভিঘাত। তিনি যেমন বলেন, কোনো মানুষের মৃত্যুদণ্ডের খবরে তাঁর আনন্দ নেই, তেমনই তিনি স্বীকার করেন মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের প্রয়োজনীয়তা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর একটি বড় অংশ মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় মূলত অপরিবর্তনীয় শাস্তির কঠোরতার কারণে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে বৈশ্বিক নৈতিকতা সাধারণত কড়া। ইতিহাসে হিটলার, মুসোলিনি বা চেঙ্গিস খানের মতো স্বৈরাচারীদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যেভাবে নিষ্ঠুরতার প্রতিফলন ঘটায়, তেমনি শেখ হাসিনার রায়ও দেশের মানুষকে ভাবিয়েছে। সেটা শ্রদ্ধা বা ঘৃণা কোনোটাই নয়, বরং এক গভীর অনুধাবন যে তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল অসীম ক্ষমতা, বিতর্ক, উন্নয়ন, দুঃশাসন এবং কঠোরতার মিশেলে তৈরি এক বহুমাত্রিক চরিত্র।
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। অনেকের কাছে তিনি উন্নয়নের প্রতীক, আবার অনেকের কাছে তিনি স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক। তাঁর সরকারের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, দুর্নীতি, দমন–পীড়ন নানা সময় সংবাদমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয়েছে। বিশেষত গত বছরের আগস্টের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্ক ওঠে। তখন অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন—তিনি কি সত্যিই অজেয়? ১৫ বছরের দীর্ঘ ক্ষমতার পরাজয় এবং পরবর্তী পলায়ন দেশের মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে গণতন্ত্রের ইতিহাসে কোনো স্বৈরশাসকই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি। মান্না নিজেও সেই সময় মনে মনে দ্বিধায় ভুগেছেন, যদিও জনসমক্ষে তিনি বলেছিলেন, “ফ্যাসিবাদ কখনো জেতে না।” বাস্তব ঘটনাপ্রবাহ তাঁর কথাকে সত্য প্রমাণ করেছে।
ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরও শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বক্তব্যের ধার থামেনি। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে আক্রমণ করে গেছেন বারবার। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী যারা ভারতে গেছে, তারাও একই সুরে কথা বলেছে। প্রবাস থেকেই দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু ভারত তাঁর পক্ষে দাঁড়ায়নি। বরং ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতি ছিল অত্যন্ত নিরাসক্ত—শুধু জানানো হয়েছে যে তারা রায়ের ব্যাপারে “অবগত”। কোনো সহানুভূতির ইঙ্গিত নেই, সমর্থন নেই, এমনকি নিন্দাও নেই। একজন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতার প্রতি এমন নিরাবেগ মনোভাব নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বার্তা বহন করে।
এখানেই উঠে আসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—ভারত কি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করবে? মান্নার মতে, সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশ যদি মনে করে তাদের আশ্রিত নাগরিককে ফেরত দিলে তাঁর জীবননাশ হতে পারে, তারা তাকে ফেরত না পাঠানোর পুরো অধিকার রাখে। এখন যেহেতু শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে, ভারত সহজেই বলতে পারে যে তাঁকে ফেরত পাঠানো মানবাধিকারবিরোধী হবে। অতীতে এমন দৃষ্টান্ত আছে। তাই ভারত চাইলে রায় কার্যকর হতে দিতে পারে, আবার চাইলে তাকে এড়িয়ে চলতে পারে। এই রাজনৈতিক সীমানা–খেলায় শেখ হাসিনা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে প্রশ্ন উঠছে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে। গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর—যে দুই জায়গাকে দলটির শক্ত ঘাঁটি ধরা হয়, সেখানে পর্যন্ত হতাশার ছাপ বাড়ছে। অনেক নেতা–কর্মী ভাবছেন, শেখ হাসিনা কি আর দেশে ফিরতে পারবেন? দল কি আবার আগের মতো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? মান্না মনে করেন, আওয়ামী লীগকে পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ ছিল। তারা ক্ষমতায় থেকে যে দুঃশাসন, দুর্নীতি, দমন–পীড়ন করেছে, তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন নেতৃত্বে রিফর্ম করা সম্ভব ছিল। দলের মধ্যে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছেন—এটা সত্যি। কিন্তু পরিবারতন্ত্র এমনভাবে দলকে আঁকড়ে ধরেছে যে কোনো বিকল্প নেতৃত্ব উঠতে পারে না। শেখ হাসিনা ছাড়া দলের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নিয়ে কেউই স্পষ্ট ধারণা দিতে পারে না।
রায়ের পরে ভারতের ভূমিকা আরও বিবেচনার দাবি রাখে। ভারতের বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের জনগণের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র এবং শান্তি চায়। এর মানে সরাসরি কিছু বলা না হলেও, তারা ঝুঁকি নিতে চাইছে না। নির্বাচনও ভারতের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের নির্বাচন সঠিক সময়ে হলে ভারতের জন্য তা সুবিধাজনক হবে। কারণ জটিলতা বাড়লে আঞ্চলিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। ভারত কোনোভাবেই যুদ্ধ বা কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে নির্বাচন থামাতে চাইবে না। ফলে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ জটিল, অস্পষ্ট এবং অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ।
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার জরুরি বৈঠকের সময়সূচি পরিবর্তিত হওয়ার ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে ভারত পরিস্থিতিকে গুরুত্বের সঙ্গেই পর্যবেক্ষণ করছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় কূটনীতি এখানে বড় ভূমিকা রাখছে। তবে ভারত যখন “অন্তর্ভুক্তি”র কথা বলছে, তখন বোঝা যাচ্ছে যে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখবে। তাদের লক্ষ্য মূলত স্থিতিশীল সম্পর্ক, বাড়তি সংঘাত নয়।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দাঁড়ায়—শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন কীভাবে শেষ হবে? তাঁকে কি বিদেশে দীর্ঘ নির্বাসনে কাটাতে হবে? নাকি রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে তিনি আবার ফিরে আসবেন? অতীতের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, এমন প্রত্যাবর্তনের উদাহরণ বিরল। বিশেষত যখন মৃত্যুদণ্ড মাথায় ঝুলছে, তখন প্রত্যাবর্তন প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। তাঁর দলও আজ ব্যাপকভাবে বিভক্ত এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ক্ষমতা হারানোর পর দল পুনর্গঠন করা কঠিন কাজ। আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতা–কর্মী এখন ভাবছেন, নতুন নেতৃত্ব আসার সুযোগ থাকলেও পরিবারতন্ত্র সেই সম্ভাবনাকে আটকে রেখেছে।
এ সবকিছুর শেষে বাংলাদেশের রাজনীতির বড় প্রশ্ন হলো গণতন্ত্র কি সত্যিই নতুন পথে যাবে? বিচারপ্রক্রিয়া, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আন্তর্জাতিক কূটনীতি—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এক সংবেদনশীল মুহূর্ত পার করছে। শেখ হাসিনার রায় যেমন রাজনৈতিক এক যুগের সমাপ্তির ইঙ্গিত দেয়, তেমনি দেশের মানুষের কাছে নতুন গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার জন্মও দিয়েছে। ক্ষমতার পরিবর্তন মানে রাজনীতির পুনর্গঠন। কিন্তু সেই পুনর্গঠন কোন পথে যাবে, তা নির্ভর করছে আগামী সরকারের সিদ্ধান্ত, জনগণের ইচ্ছা এবং আঞ্চলিক কূটনীতির ওপর।
মান্না শেষ দিকে বলেন, শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় আবার মনে করিয়ে দিয়েছে—কেউ অজেয় নয়। এটি শুধু শেখ হাসিনার পরিণতি নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির নতুন অধ্যায়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন শুরু হয়েছে, মানুষ নতুন করে ভাবছে রাজনীতিকে নিয়ে। আওয়ামী লীগ কি পুনর্গঠিত হবে, নাকি রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় এক নতুন গল্প লিখবে—এই প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে।
আপনার মতামত জানানঃ