বাংলাদেশে সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং পুরো সাংবাদিকতা পেশার সংকটকে নতুন করে সামনে এনেছে। বাসা থেকে বের হওয়ার পর তার নিখোঁজ হওয়া এবং পরে নদী থেকে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাই যথেষ্ট আলোড়ন তৈরি করেছে। এর আগেই তিনি স্থানীয় একটি গণমাধ্যমে নিজের লেখা পাঠিয়ে যান, যেখানে ফুটনোটে উল্লেখ করেছিলেন—“জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।” সেই লেখায় তিনি জানিয়ে গেছেন দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় সাংবাদিকতা করেও সম্মানজনক বেতন-ভাতা না পাওয়া, আর্থিক দুঃস্থতা, ধার-দেনা করে সংসার চালানোর কষ্ট এবং কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিজ্ঞতা।
বিভুরঞ্জনের মৃত্যুর পর সাংবাদিক সমাজের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার প্রকাশ ঘটেছে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছেন, সাংবাদিকরা খ্যাতি পেলেও বেতন পান না, সংসার চালানোই কষ্টকর হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বলেছেন, নিয়মিত বেতন না পেয়ে পরিবারের প্রয়োজন মেটানো যায় না, অথচ এই সমস্যার কথা প্রকাশ করতেও ভয় পান তারা। টেলিভিশন সাংবাদিকরা ওয়েজবোর্ড কাঠামোর আওতায় আসেননি, ফলে ন্যায্য পাওনা আদায় করাও প্রায় অসম্ভব। এক সাংবাদিক উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, চার বছর আগে তার বেতন ছিল ১৭ হাজার, এখন ২৭ হাজার, অথচ একই সময়ে অন্য সেক্টরের সহপাঠীরা অনেক এগিয়ে গেছেন।
অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি সাংবাদিকরা রাষ্ট্রীয় চাপ ও সেন্সরশিপের মুখেও পড়ছেন। বিভুরঞ্জন তার শেষ লেখায় উল্লেখ করেছেন, সরকার পরিবর্তনের পরও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হয়েছে। সম্পাদক থেকে শুরু করে রিপোর্টার পর্যন্ত সবাইকে সংবাদ প্রকাশের আগে নানা ধরনের ফোন কল ও চাপের মুখে পড়তে হয়। এতে সাংবাদিকরা স্বেচ্ছায় “সেলফ-সেন্সরশিপ”-এর মধ্যে ঢুকে পড়ছেন। প্রবীণ সাংবাদিকরা মনে করেন, সব সরকারের আমলেই গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে, শুধু রাজনৈতিক দল পাল্টেছে কিন্তু বাস্তবতা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকটের মূল কারণ রাজনৈতিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, আর্থিক সংকট যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে, তবে ভয়ের ধরণ বদলেছে। আগে বিশেষ বাহিনী সম্পাদককে ফোন করত, এখন সরাসরি রিপোর্টারকে বলা হয় কোন খবর করা যাবে না। প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ মনে করেন, বিভুরঞ্জনের মৃত্যু গণমাধ্যমের শূন্যতা ও রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। সাংবাদিক তৌহিদুর রহমান মনে করেন, দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক শক্তি ও অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী গণমাধ্যমকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে, ফলে সাংবাদিকদের জন্য টেকসই ও স্বাধীন আর্থিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সাংবাদিকরা ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্য গড়ে তোলা, ফ্রিল্যান্স ও সহযোগিতামূলক সাংবাদিকতার বিস্তার ঘটানো, ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নে মালিকপক্ষকে বাধ্য করা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত আর্থিক কাঠামো তৈরি করা ছাড়া বিকল্প নেই। বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু তাই কেবল একটি দুঃখজনক ঘটনা নয়, বরং সাংবাদিকতার নীরব শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক অনুচ্চারিত প্রতিবাদ, যা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেয় যে এখনই কাঠামোগত পরিবর্তনের সময়।
আপনার মতামত জানানঃ