বাংলাদেশে বহু বছর ধরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকদের উপর দমন-পীড়নের অভিযোগ পুরনো হলেও বর্তমান বাস্তবতা আরও ভয়াবহ। একদিকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের আশায় অনেকেই ভেবেছিলেন, হয়তো নতুন পরিবেশে মুক্তভাবে মতামত জানানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটা ঠিক উল্টো—যেন আরেক স্তরের ভয়, চাপ আর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ।
বেসরকারি একটি টেলিভিশনের সাংবাদিক ফজলে রাব্বীর অভিজ্ঞতা যেন এই ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। জুলাই হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা নিয়ে একজন উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি, যেটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই তার চাকরি হারাতে হয়। আজ প্রায় তিন মাস ধরে বেকার তিনি। তার বক্তব্য, “একটা ট্যাগ দিয়ে দিয়েছে আমাকে। এখন চাকরির জন্য বড় ভাইদের কাছে গেলে তারা অপেক্ষা করতে বলে। ওনারাও ভয় পান।” একজন সংবাদকর্মী শুধুমাত্র একটি তথ্যভিত্তিক প্রশ্ন করার জন্য চাকরি হারান এবং ভবিষ্যতের পেশাগত জীবন নিয়েও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন—এটাই বাংলাদেশে সাংবাদিকতার সাম্প্রতিক বাস্তবতা।
আরেকজন সাংবাদিক, অনলাইন মিডিয়া ও ইউটিউব বিশ্লেষক নুরুজ্জামান লাবুও একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। নিজের বিশ্লেষণমূলক কনটেন্টে বর্তমান বাস্তবতা তুলে ধরায় সামাজিক মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়। তার ভাষায়, “সত্য বললেই সেটা কারও না কারও পক্ষে যায়। কিন্তু সেটাকেই পুঁজি করে কথা বন্ধ করার চেষ্টা চলে।” আজ তিনি আর কোনো কনটেন্টই তৈরি করছেন না, কারণ ‘মব’ কিংবা ‘নন-স্টেট অ্যাক্টরদের’ হুমকি তাকে নিরব করে দিয়েছে। তার মর্মস্পর্শী প্রশ্ন—”মব আসলে কাকে ফোন করবো? কে বাঁচাবে আমাকে?”
এই ভয়-ভীতি আর নিরবতার বাস্তবতা সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, “আগে এক ধরনের কৃত্রিম স্বাধীনতা ছিল। এখন সব একতরফা, একচেটিয়া।” তার মতে, বর্তমান সরকার কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থা কেউই সাংবাদিকদের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। আগে যখন মতপার্থক্য থাকলেও সংবাদমাধ্যমে নানা মত প্রকাশ পেত, আজ সেখানে একরৈখিক বয়ান ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন—নিরাপত্তা সংস্থা ও ফোন ট্র্যাকিং ব্যবস্থার সংস্কারের অভাব। তাঁর মতে, “ফোন ট্র্যাকিংয়ের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি আনা হয়েছিলো, সেগুলো এখনো আগের জায়গাতেই আছে। এর অপব্যবহার হবে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।” তিনি বলেন, এসব সংস্থা ও কাঠামোর বাস্তব সংস্কার ছাড়া পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু এই নিয়ে কোনো আলোচনাই হচ্ছে না।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ভিন্নমতের সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার, প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল, বা গণমাধ্যমের ওপর মব তৈরি করে চাপ সৃষ্টি করার প্রবণতা। বিভিন্ন সময় এসব ঘটনাকে তলিয়ে না দেখে বরং প্রতিষ্ঠানগুলোকেই লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে, একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কোনো অভিযোগ না থাকলেও ‘মিথ্যা মামলা’ দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। ফলে সাংবাদিকরা ভয়, উদ্বেগ আর আত্মনিরপত্তার অভাবে চুপ থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
সরকারের দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। জাতিসংঘ পর্যন্ত যেসব গোয়েন্দা সংস্থাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার জন্য দায়ী করেছে, তাদের সংস্কার নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অবস্থানই স্পষ্ট হয়নি। সংবাদমাধ্যমে ভিন্নমত, অনুসন্ধান কিংবা সরকার-বিরোধী বক্তব্য শেয়ার করলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ, সাংবাদিক বরখাস্ত বা মামলার হুমকি অব্যাহত রয়েছে। সবচেয়ে হতাশাজনক হলো—এখনো এমন কোনো আইনি কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি যা মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা দেবে।
মোস্তফা ফিরোজের বক্তব্যেই যেন এই সংকটের সারসংক্ষেপ পাওয়া যায়—“আপনি তো যেকোনো সময় যেকোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারেন। সেই ধারা তো এখনো রয়ে গেছে। বাতিল করেননি। এমনকি ন্যূনতম একটি অধ্যাদেশও জারি করেননি। কিছুই হয়নি!”
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে—বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেবল একটি সাংবিধানিক বুলি নাকি বাস্তবতাবর্জিত একটি অলীক কল্পনা? যদি সরকার সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা রক্ষায় আগ্রহী হয়, তবে তাকে আগে ভয়ের সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। নইলে পরিবর্তিত সরকার এসে গেলেও পরিবর্তিত বাস্তবতা আসবে না—শুধু পোশাক বদলাবে, চরিত্র নয়।
আপনার মতামত জানানঃ