পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের চাইতেও আলোচনার কেন্দ্রে যে একজন মানুষ, তিনি ফিল্ড মার্শাল সৈয়দ আসিম মুনির আহমেদ শাহ। ৫৭ বছর বয়সী এই সেনা কর্মকর্তা চার তারকা জেনারেল থেকে পাঁচ তারকা ফিল্ড মার্শাল হয়েছেন, সেনাপ্রধানের চেয়ার পেরিয়ে এখন তিনি “সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান”—অর্থাৎ সেনা, নৌ, বিমান, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পারমাণবিক কমান্ডসহ পাকিস্তানের সমস্ত নিরাপত্তা কাঠামোর শীর্ষস্থানে অবস্থান করছেন। সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী তাঁকে কার্যত আইনের ঊর্ধ্বে এক ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, যা পাকিস্তানের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
আসিম মুনিরের জন্ম রাওয়ালপিন্ডিতে, এমন এক পরিবারে যেখানে ইসলামি মূল্যবোধ, শিক্ষা এবং শৃঙ্খলা ছিল অপরিহার্য অংশ। তাঁর পরিবার ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ভারতীয় পাঞ্জাবের জলন্ধর থেকে পাকিস্তানে আসে। শৈশবেই তাঁর জীবনে গ্রামীণ সরলতা এবং কড়াভাবে নিয়ন্ত্রিত পারিবারিক পরিবেশ বড় ভূমিকা রাখে। ক্রিকেটে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল—দ্রুত গতির বল করতে পারতেন, যা তাঁর শারীরিক সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতামুখী মানসিকতার পরিচায়ক। পাশাপাশি ধর্মীয় অধ্যয়নেও তিনি ছিলেন মনোযোগী। তাঁর বাবা ছিলেন একাধারে শিক্ষক ও ইমাম—যিনি পরিবারে ধর্ম, শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার ভিত্তি রচনা করেন।
রাওয়ালপিন্ডির একটি মাদ্রাসায় তাঁর ধর্মীয় পড়ালেখা শুরু। এরপর অ্যাবোটাবাদের পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হয়ে তিনি যে অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তা তাঁকে “সোর্ড অব অনার” এনে দেয়—যা পাকিস্তানি সামরিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সম্মান। এখান থেকেই শুরু তাঁর বহুল আলোচিত সামরিক যাত্রা।
পরবর্তী সময়ে তিনি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই এবং পরে আইএসআই-এর প্রধান হন। এ দুটি সংস্থার নেতৃত্ব তাঁকে পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। ২০২২ সালে তিনি সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন দেশের রাজনৈতিক উত্তাল সময়ের মধ্যে—ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত, রাস্তায় বিক্ষোভ, আদালতে মামলা, যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে বিতর্ক—সব মিলিয়ে এটি ছিল অশান্ত এক প্রেক্ষাপট।
২০২৫ সালের মে মাসে ভারত–পাকিস্তানের সীমান্ত সংঘাত—টানা চার দিনের সামরিক উত্তেজনা—পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী আবহ তৈরি করে এবং সেই আবহেই আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়। এই পদ পাকিস্তানে অত্যন্ত বিরল; তাঁর আগে মাত্র একজন—আইয়ুব খান—এই সামরিক সম্মান পেয়েছিলেন। তবে আইয়ুব খানের পদোন্নতি ছিল স্বঘোষিত এবং বিতর্কিত; তাই মুনিরের এই উন্নতি পাকিস্তানে আবারও সামরিক ক্ষমতার উত্থানকে নির্দেশ করে।
এরপর আসে সবচেয়ে আলোচিত পরিবর্তন—সংবিধানের সংশোধন। মাত্র এক দিনের ব্যবধানে জাতীয় সংসদে ২৪৩ নম্বর ধারা বদলে দেওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষর করেন। ফলাফল—ফিল্ড মার্শাল মুনির এখন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী পর্যন্ত তত্ত্বাবধান করবেন। তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে কোনো মামলা করা যাবে না। অবসরের পরও একই মর্যাদা বজায় থাকবে এবং তাঁকে জাতীয় পরিসরে দায়িত্ব দেওয়া হবে। অর্থাৎ তিনি আজীবন প্রভাবশালী অবস্থানে থাকবেন—একটি রাষ্ট্রক্ষমতার চূড়ায়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন—এটি “সামরিক নিয়ন্ত্রিত বেসামরিক শাসনব্যবস্থা”র নতুন রূপ। কেউ কেউ এটিকে “হাইব্রিড শাসন”-এর পরবর্তী স্তর—যেখানে সেনাবাহিনী পর্দার আড়াল থেকে নয়, প্রকাশ্যভাবেই রাষ্ট্রকাঠামোর কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আসিম মুনিরের কূটনৈতিক প্রভাবও নজরকাড়া। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে “ঘনিষ্ঠ বন্ধু” বলে অভিহিত করেছিলেন। আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সহযোগিতা, ইরানসংক্রান্ত গোপন সমন্বয়, মার্কিন ড্রোন ফ্লাইটের অনুমতি—এসব কারণে ওয়াশিংটনে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। বিনিময়ে পাকিস্তান মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম এবং কূটনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে।
অন্যদিকে, চীনের প্রতিও তিনি অতি ঘনিষ্ঠ। চীন–পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) রক্ষায় তাঁর ভূমিকাই মূল। চীনা কর্মকর্তা ও সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর টানা বৈঠকগুলো দেখায়—পাকিস্তান এখন বেইজিংয়ের কৌশলগত অংশীদারিত্ব শক্তিশালী করতে চাইছে এবং মুনির সেই সম্পর্কের স্থপতি।
তবে তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত সম্পর্ক ইমরান খানের সঙ্গে। ইমরান অভিযোগ করেন—মুনির তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর ওপর দমননীতি প্রয়োগ করছেন, পিটিআই নেতাদের গ্রেপ্তার ও নিপীড়ন বাড়িয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোও একই ইঙ্গিত দেয়—পাকিস্তানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমে গেছে, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ কঠোর হয়েছে, বিচারব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে “সংবিধানিক আদালত” নামে নতুন কাঠামো আনা হয়েছে—যা অনেকেই সেনাবাহিনীর প্রভাববলয় বিস্তারের উপায় হিসেবে দেখছেন।
সব মিলিয়ে আজকের পাকিস্তানের ক্ষমতার অক্ষরেখা এক কেন্দ্রেই ঘোরে—তিনি ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। তাঁর হাতে সামরিক, কূটনৈতিক, পারমাণবিক ও নিরাপত্তা কাঠামোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। বেসামরিক সরকার কার্যত তাঁর ওপর নির্ভরশীল। তাঁকে অপসারণ করা প্রায় অসম্ভব।
দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎও অনেকাংশে তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। তিনি যদি অঞ্চলে শান্তি ও কৌশলগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখেন, তাহলে তাঁর নাম ইতিহাসে ইতিবাচকভাবে জায়গা পেতে পারে। কিন্তু যদি তিনি সংঘাতমুখী পথ বেছে নেন, তাহলে ২০২৫ সালের চার দিনের যুদ্ধ কেবলই একটি সতর্কসংকেত ছিল—এর পরিণতি আরও বিস্তৃত হতে পারে।
পাকিস্তানের ভেতরে গণতন্ত্রের গতি, রাজনৈতিক ভারসাম্য, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, মানবাধিকার—সবকিছু এখন এক ব্যক্তির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। এই কারণেই অনেকেই তাঁকে “এক যুগের প্রতিচ্ছবি” বলছেন—এক এমন যুগ, যেখানে রাষ্ট্রের ভাগ্য গড়ে দেওয়া বা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা মাত্র একজন মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত।
আপনার মতামত জানানঃ