দেশে সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। পাঁচই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এক বছরের বেশি সময় কেটে গেলেও দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। নানা জায়গায় বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ধর্ষণ, লুটপাটের পাশাপাশি পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাও উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। যারা দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দেবে, সেই বাহিনীর সদস্যরাই এখন অনেক ক্ষেত্রে হামলার শিকার হচ্ছেন। এতে জনগণের মনে পুলিশ সম্পর্কে যে আস্থা থাকা দরকার, তা ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—যদি পুলিশই নিরাপদ না থাকে, তবে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা পাবে কীভাবে?
গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত ‘মব হামলা’ বা গণআক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৪১৫টি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, কোনো অভিযানে গেলে বা অপরাধ দমন করতে চেষ্টা করলে পুলিশ উল্টো হামলার মুখে পড়ে। সম্প্রতি নরসিংদীতে পুলিশের ওপর এমনই এক হামলায় আহত হন একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। একইভাবে সিলেট ও কোম্পানীগঞ্জেও গত সপ্তাহে পুলিশকে লক্ষ্য করে মব হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন।
এসব ঘটনার ফলে সাধারণ মানুষের মনে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। মানুষ ভাবছে—যদি পুলিশের ওপরই হামলা হয়, তবে তাদের নিজের নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত? এক সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শক্তিশালী হিসেবে দেখা হলেও, এখন সেই ভাবমূর্তি নড়বড়ে। এমনও দেখা গেছে, কোনো সংঘর্ষ বা বিশৃঙ্খলার ঘটনায় পুলিশ পিছু হটেছে বা আত্মরক্ষায় ব্যস্ত থেকেছে। ফলে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় জন্ম নিচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামায়। কিন্তু এতে পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হয়নি। বরং একের পর এক বিশৃঙ্খল ঘটনার খবর প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল বাহিনী পরিবর্তন বা অভিযান চালানোই যথেষ্ট নয়—এখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রশাসনিক সমন্বয়, মনোবল পুনর্গঠন ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার।
অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেছেন, পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে চোখে পড়ার মতো সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এই ব্যবধানই মাঠের বাস্তবতায় বড় প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, “যখন অপরাধীরা বুঝে যায় যে পুলিশের ভিতরে সমন্বয়হীনতা আছে, তখন তারা আরও সাহসী হয়ে ওঠে। কারণ তারা জানে, হামলা করলে হয়তো বড় কোনো ফল ভোগ করতে হবে না।”
পুলিশের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের অভাব শুধু সংগঠনের দুর্বলতা নয়, এটি পুরো সমাজে অপরাধ বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের ভেতরে মনোবল ও দায়িত্ববোধে ঘাটতি তৈরি হলে তা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। পুলিশ যদি নিজেই নিরাপদ না থাকে বা আত্মবিশ্বাস হারায়, তবে অপরাধী চক্র আরও সংগঠিত হয় এবং সমাজে ভয় ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, দেশে অপরাধ দমনে অভিযান চালানো হলেও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। বরং গণপিটুনি, ছিনতাই, ধর্ষণ, রাজনৈতিক সহিংসতা ও ধর্মীয় উগ্রতার ঘটনা বেড়েছে। ‘তৌহিদী জনতা’র নামে বহু জায়গায় মব সৃষ্টি করে হামলা ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এই ধরনের ঘটনাগুলোর বড় অংশই ঘটছে প্রশাসনের নাকের ডগায়।
পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাগুলো কেবল আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার প্রতিও সরাসরি হুমকি। বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র এআইজি এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেছেন, “পুলিশের ওপর হামলা মূলত আইনের শাসনের প্রতি চ্যালেঞ্জ। এমন ঘটনা সমাজে ভুল বার্তা দেয়—যেখানে অপরাধীরা মনে করে তারা আইন নিজেদের হাতে নিতে পারে। এটি শুধু পুলিশের জন্য নয়, পুরো সমাজব্যবস্থার জন্যই বিপজ্জনক।”
তিনি আরও বলেন, “হামলার পর মনোবল কিছুটা কমে যাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু বাহিনীর কাঠামো ও প্রশিক্ষণ এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যাতে তারা দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পারে।” তবে তিনি এটিও স্বীকার করেছেন যে, এই পরিস্থিতি পুলিশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে নীরবতা পালন করছেন। পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের পর অনেক কিছুই ঘটেছে। এখন পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক বলা যায়। ঢাকায় তো এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।” তবে বাস্তবতার সঙ্গে এই বক্তব্যের পার্থক্য স্পষ্ট। কারণ রাজধানীর বাইরেও তো দেশ আছে, যেখানে প্রতিদিনই নতুন করে অস্থিরতার খবর আসছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুলিশ বাহিনীর মনোবল এখন বড় পরীক্ষার মুখে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে পুলিশের ভেতরে একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্য মনে করছেন, তারা এখন আর আগের মতো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহায়তা পাচ্ছেন না। ফলে দায়িত্ব পালনের সময় তারা নিজেকে একা ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় অনুভব করছেন।
ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, “গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার যখন ‘মব’ তৈরি করা অপরাধীদের প্রতি নমনীয়তা দেখিয়েছে, তখন পুলিশ নিজেই সেই পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। এটা এক ধরনের নৈতিক দুর্বলতা তৈরি করেছে।”
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশকে শুধু সরঞ্জাম বা বাহিনী বাড়িয়ে দিলেই হবে না—প্রয়োজন আস্থা ও ন্যায়ের পরিবেশ তৈরি করা। সাধারণ মানুষ যদি পুলিশের ওপর বিশ্বাস না রাখে, তবে তারা আইনকে নিজের হাতে তুলে নিতে শুরু করে। গণপিটুনি বা ‘মব জাস্টিস’-এর ঘটনা তারই প্রতিফলন।
একটি সমাজে যখন মানুষ বিচার পায় না, বা পুলিশের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা খুঁজে পায় না, তখন তারা নিজেরাই বিচারক হয়ে ওঠে। এটি কেবল একটি আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়—এটি রাষ্ট্রীয় বিশ্বাসের সংকট। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতেও সেই সংকট স্পষ্ট।
বেশ কিছু সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, পুলিশের ভাবমূর্তি পুনর্গঠনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। তারা বলছেন, “যদি পুলিশকে মানুষ আবার বিশ্বাস করতে শুরু না করে, তাহলে কোনো অভিযান, কোনো বাহিনী, কোনো আইনই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না।”
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি দরকার প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও সুশাসন। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা বা তাদের ব্যর্থতা নিয়ে শুধু সমালোচনা নয়, প্রয়োজন তাদের নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ ও মানসিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। কারণ, একটি ভয়ভীত সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
বর্তমান বাস্তবতায় সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো—পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং জনগণের সঙ্গে বিশ্বাস পুনর্গঠন। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, “পুলিশ যদি নিজেদের বদলাতে না পারে, তবে সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব।”
আজকের বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধু পুলিশের নয়—এটি পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের এবং নাগরিক সমাজেরও। কিন্তু যখন পুলিশের হাত বাঁধা, মনোবল ভাঙা, আর বিশ্বাস ক্ষয়ে যায়, তখন অপরাধীরাই সাহসী হয়ে ওঠে। এই চক্র ভাঙতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন সত্যিকার অর্থে পেশাদার, সুশিক্ষিত ও মানবিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা।
অন্যথায়, যদি পুলিশই ‘মবের শিকার’ হতে থাকে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ধারণাটিই ভেঙে পড়বে। তখন আইন থাকবে, কিন্তু নিরাপত্তা থাকবে না—আর সেটিই হবে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
আপনার মতামত জানানঃ