
বাংলাদেশে নতুন একটি সক্রিয় ফাটলরেখা শনাক্ত হওয়ার খবর শুধু বৈজ্ঞানিক তথ্য নয়—এটি বাংলাদেশের ভূগর্ভ, ভূতত্ত্ব, জননিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ দুর্যোগপ্রবণতার একটি গভীর ও বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক গবেষকদের সহযোগিতায় পরিচালিত আক্তারুল আহসানের গবেষণা দেখিয়েছে যে জামালপুর ও ময়মনসিংহ হয়ে ভারতের কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নতুন ফাটলরেখা শুধু ভূতাত্ত্বিক আবিষ্কারই নয়, বরং এটি আমাদের ভূমিকম্প–ঝুঁকির মানচিত্রকে নতুন করে লেখা শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ডাউকি ফাটলরেখা ও ইন্দোবার্মা মেগাথ্রাস্টকে বড় ঝুঁকির উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হতো, কিন্তু নতুন ফাটলরেখা যুক্ত হওয়ায় গোটা উত্তর-উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এক নতুন আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে।
এই ফাটলরেখার একটি অংশ ভূমিকম্পপ্রবণ, যা সর্বোচ্চ ৬ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে সক্ষম বলে গবেষণা তুলে ধরেছে। যদিও ৬ মাত্রাকে বিশ্বের অনেক জায়গায় মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয়, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ, দুর্বল অবকাঠামোর দেশে এটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সাম্প্রতিক ২১ নভেম্বরের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পেই ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন—এ নিজেই দেখায় আমাদের প্রস্তুতির বাস্তবতা কতটা নাজুক।
এই নতুন আবিষ্কারকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে এর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস। গবেষণা বলছে, ফাটলরেখাটির জন্ম প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে, ইউসিন যুগে। এরপর ২ কোটি ৩০ লাখ বছর ধরে মায়োসিন যুগে এটি নিষ্ক্রিয় ছিল। কিন্তু প্রায় ৫৬ লাখ বছর আগে ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষ বাড়তে থাকায় মেঘালয়ের পর্বতমালা ভূত্বকের নিচ থেকে উঠে আসে এবং তখন থেকেই এই ফাটলরেখাটি আবার সক্রিয় হতে শুরু করে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে টেকটোনিক শক্তির যে জটিল অভ্যন্তরীণ নকশা চলছে, এই আবিষ্কার তা আমাদের সামনে আরও স্পষ্ট করে দেখায়।
ইন্ডিয়ান প্লেট প্রতিবছর প্রায় ৪৬ মিলিমিটার গতিতে ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে—এই নিরবচ্ছিন্ন গতি শুধু পাহাড় সৃষ্টি করেনি, বরং ফাটলরেখাগুলোর জন্ম, সক্রিয়তা ও পুনরায় সক্রিয় হওয়ার প্রক্রিয়াকেও চালিত করেছে। ডাউকি ফাটলরেখা যেমন এ ধাক্কার ফল, তেমনি নতুন আবিষ্কৃত ফাটলরেখাটিও এই একই ভূ-জৈব প্রক্রিয়ার অংশ। ইন্ডিয়ান প্লেটের এই গতি একেক সময় একেক দিকে—কখনো সরাসরি উত্তরে, কখনো উত্তর-পূর্বে—পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনশীল গতিবিধির কারণেই ফাটলরেখাগুলোর জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্ম ঘটে চলেছে।
নতুন ফাটলরেখা শনাক্ত করার ক্ষেত্রে গবেষকরা ‘টেকটোনিক জিওমরফলোজি’ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এই পদ্ধতিতে ভূমির আকৃতি, নদীর গতিপথ, পাহাড়ের ধাপ, ভূমির ঢাল—সবকিছু মিলিয়ে ভূগর্ভস্থ পরিবর্তনের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তৈরি করা যায়। এ ধরনের গবেষণায় সাধারণত স্যাটেলাইট ইমেজ, ডিজিটাল এলিভেশন মডেল, স্পর্শকাতর ভূমি পরিমাপ প্রযুক্তি এবং পুরোনো ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল মিলিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। ফলে এ গবেষণার ফলাফল উচ্চমানের ও বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য।
এই ফাটলরেখার সঙ্গে বড় ভূমিকম্পের সম্পর্কও পাওয়া গেছে। যেমন ১৮৮৫ সালের ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’, যার মাত্রা ছিল প্রায় ৭। এই ভূমিকম্পে ঢাকা, ভারত, ভুটান, মিয়ানমারসহ বিশাল অঞ্চলে কম্পন ছড়িয়েছিল এবং অন্তত ৭৫ জন নিহত হয়েছিলেন, যার ৪০ জনই ছিলেন শেরপুরের মানুষ। একইভাবে ১৯২৩ সালের ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিল ৬.৯—এই নতুন ফাটলরেখার সঙ্গে যুক্ত বলে গবেষণা জানায়। অর্থাৎ, নতুন ফাটলরেখাটি শুধু তাত্ত্বিক উপস্থিতি নয়, বরং এর ওপর ভিত্তি করে অতীতে শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটেছে—এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ।
ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গেও এই নতুন ফাটলরেখার সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ভূতত্ত্ববিদরা বহুদিন ধরেই অনুমান করে আসছিলেন যে ব্রহ্মপুত্রের হঠাৎ বাঁক পরিবর্তন টেকটোনিক উত্তোলন বা ভূমিকম্পজনিত বদলের ফল। নতুন গবেষণা সে অনুমানেরই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বাড়িয়েছে। নদীটির গতিপথ এখনো বদলে চলেছে, যা ভবিষ্যতে উত্তরাঞ্চলে ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক আশরাফুল আলম যেমন বলেছেন—বাংলাদেশে ফাটলরেখার সংখ্যা অনেক, এবং গবেষণা করলে আরও পাওয়া যাবে। ফাটলরেখা থাকা মানেই আতঙ্ক নয়; বরং কোন ফাটল কত শক্তি ধরে রাখতে পারে, কত সময় পর পর তা মুক্ত হয়, কোন অংশে বেশি সঞ্চিত চাপ রয়েছে—এসবই গুরুত্বপূর্ণ। সব ফাটল ভূমিকম্প তৈরি করে না, কিন্তু যেসব ফাটল করে, সেগুলোর আচরণ বুঝতে পারলেই ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হয়।
ভূমিকম্পবিজ্ঞানীদের পুরোনো গবেষণায় দেখা যায়, ১৫৪৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অন্তত ৩৩টি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। ১৮৯৭ সালের আসাম ভূমিকম্প—৮.৭ মাত্রা—প্রায় ৪ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছিল। ১৮৪২, ১৮৪৬, ১৮১২, ১৯১৮, ১৯২৩—প্রতিটি বড় ভূমিকম্পই দেখিয়েছে এই অঞ্চল ভূতাত্ত্বিকভাবে কতটা সক্রিয়। নতুন গবেষণা এসব পরিসংখ্যানকে আরও শক্তিশালী ভিত্তি দেয় এবং বুঝিয়ে দেয় যে ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি অবশ্যম্ভাবী।
আক্তারুল আহসান জানিয়েছেন যে ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের সম্মেলনে এই গবেষণার পুরো ফলাফল উপস্থাপন করা হবে। এরপর এটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হবে। এর অর্থ হলো গবেষণাটি বৈজ্ঞানিক মহলে যাচাই-বাছাইয়ের কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে এবং এরপর এর বিশদ তথ্য জনসমক্ষে আসবে।
বাংলাদেশের জন্য এই গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। একদিকে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে শহরগুলো বেড়ে উঠছে পরিকল্পনাহীনভাবে। রাজউকের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়—ঢাকায় বড় ভূমিকম্প হলে ৪০% ভবন ধসে পড়তে পারে। রাজধানীর মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তা হবে অভাবনীয় বিপর্যয়। ভবন নির্মাণে কোড মানা, স্কুল-হাসপাতালের মতো সরকারি ভবনগুলোকে রেট্রোফিট করা, দুর্যোগ প্রস্তুতি বাড়ানো—এসবই এখন জরুরি।
নতুন ফাটলরেখার তথ্য আমাদের সতর্ক করে দেয়, কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং এ তথ্যকে কাজে লাগিয়ে ঝুঁকি কমানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় মানুষের আচরণ, উদ্ধার পদ্ধতি, জরুরি প্রস্তুতি, বিল্ডিং কোড—এসব নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি বাস্তবভিত্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ ভূমিকম্প–ঝুঁকিপূর্ণ দেশে রূপান্তরিত হয়নি আজকে। বহু লক্ষ বছর ধরে এ ভূখণ্ড টেকটোনিক সংঘর্ষের অংশ। কিন্তু প্রথমবারের মতো আমরা সেই লুকানো বাস্তবতাকে বৈজ্ঞানিকভাবে শনাক্ত করছি। আক্তারুল আহসানের এই গবেষণা সেই বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করে, এবং আমাদের সামনে এমন এক ভূ-মানচিত্র তুলে ধরে যা ভবিষ্যৎ উন্নয়ন, নগর পরিকল্পনা, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং মানবজীবন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায় শুরু করবে।
আপনার মতামত জানানঃ