
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বাংলাদেশে অনলাইন কনটেন্ট অপসারণ নিয়ে যে আলোচনা তৈরি হয়েছে, তা ক্রমেই জনমতের কেন্দ্রে উঠে এসেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন—এই ছয় মাসের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে গুগল, যেখানে দেখা যায় সরকারি সংস্থাগুলো মোট ২৭৯টি অনুরোধ পাঠিয়েছে কনটেন্ট মুছে ফেলার জন্য। এসব অনুরোধের অধিকাংশই ছিল সরকারের সমালোচনামূলক ভিডিও বা পোস্ট সরানোর বিষয়ে। বিস্ময়কর বিষয় হলো, আগের বছরের তুলনায় অনুরোধ কম হলেও সমালোচনামূলক কনটেন্ট অপসারণের চেষ্টাই বছরের শুরুতে সবচেয়ে বেশি হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে যেখানে অনুরোধ ছিল ৩৩৭টি, সেখানে ২০২৫ সালের একই সময়ে অনুরোধ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭৯। তবে অনুরোধের এই সংখ্যাগত হ্রাসের মধ্যেও কনটেন্ট আইটেম হিসেবে সরকার সরাতে চেয়েছে ১ হাজার ২৩টি, যা দেখায়—প্রতি অনুরোধে একাধিক কনটেন্টকে লক্ষ্য করে অভিযোগ জানানো হয়েছে। এই পরিসংখ্যান প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক—সরকারের স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি আসলে কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং অনলাইন মতের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী গুগলের স্বচ্ছতা প্রতিবেদন এমন একটি নথি, যা দেখায় কোন দেশের সরকার বা সংস্থা কী ধরনের কনটেন্ট সরাতে চায় এবং কেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের অনুরোধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি—১৮১টি—থাকা সমালোচনামূলক কনটেন্ট নিয়ে। বিশেষ করে ইউটিউবের ভিডিও অপসারণই ছিল অনুরোধগুলোর প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) পাঠিয়েছে সর্বোচ্চ অনুরোধ, যা দেখায়—এই সংস্থাই অনলাইনে রাষ্ট্রবিরোধী বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এমন সব কনটেন্ট পর্যবেক্ষণে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। তবে এই পর্যবেক্ষণ কতটা যুক্তিসঙ্গত, কোন পর্যায়ে গিয়ে তা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় আঘাত হানে—এই নিয়ে প্রশ্ন উঠে এসেছে।
গুগল জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পাঠানো অনুরোধের ৬৫ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না। অর্থাৎ অনুরোধ পাঠানো হলেও তা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক বা যথেষ্ট প্রমাণ–সমর্থিত ছিল না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুগল কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। মোট অনুরোধের ১৬.১ শতাংশে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। ৯ শতাংশ কনটেন্ট আগেই সরানো ছিল, তাই অতিরিক্ত কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়নি। আবার ৩.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কনটেন্ট খুঁজেই পাওয়া যায়নি, যা দেখায় অনেক অনুরোধ তড়িঘড়ি বা অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে পাঠানো হয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়ায় সরানো কনটেন্টের হার মাত্র ২.৫ শতাংশ। নীতি অনুসারে সরানো হয়েছে ৩.৭ শতাংশ কনটেন্ট।
এই সংখ্যাগুলো শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয় না, বরং দেখায় যে কনটেন্ট সরানোর চেষ্টাগুলো অধিকাংশই যুক্তির চেয়ে অধিক নিয়ন্ত্রণমূলক মনোভাব থেকে এসেছে। অন্যদিকে ইউটিউব নিজস্ব কমিউনিটি গাইডলাইনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকে ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই ৬ লাখ ২১ হাজার ৬৫৫টি ভিডিও সরিয়েছে। এগুলো কোনো সরকারি অনুরোধ নয়, বরং প্ল্যাটফর্মের নিজের নিয়ম লঙ্ঘনের কারণে সরানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভুয়া তথ্য, সহিংসতা, ঘৃণাত্মক বক্তব্য, শিশু নিরাপত্তা–বিরোধী কনটেন্টসহ নানা বিষয়। কিন্তু ঠিক কোন কনটেন্ট বাংলাদেশ সরকার সরাতে চেয়েছিল, তার বিস্তারিত এখনও প্রকাশ করা হয়নি। ফলে মানুষ জানতে পারছে না, কোন সমালোচনায় রাষ্ট্র বিরক্ত এবং কোন মতকে দমন করতে চায়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করেছিল। এই নতুন অধ্যাদেশের ধারা ৮ অনুযায়ী বিটিআরসি সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মে কনটেন্ট ব্লক করার অনুরোধ করতে পারে, ঠিক আগের আইনগুলোর মতোই। তবে নতুন সংযোজন ছিল সরকার সব ব্লক হওয়া কনটেন্টের তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করবে—স্বচ্ছতার স্বার্থে। কিন্তু গুগলের রিপোর্ট অনুযায়ী অনুরোধ পাঠানো হলেও সরকার এখনও পর্যন্ত প্রকাশ করেনি—কোন কনটেন্ট, কোন বক্তব্য বা কোন ভিডিও ঠিক কোন আইনি বা নৈতিক ভিত্তিতে সরাতে চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, যেহেতু নতুন অধ্যাদেশে তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে, তাই এই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। নইলে মানুষ বুঝতে পারবে না, সমালোচনা কোন পর্যায়ে গিয়ে সরকারের কাছে “অগ্রহণযোগ্য” হয়ে ওঠে।
তথ্য গোপন রাখার এই প্রবণতা শুধু অনলাইন পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা নয়, বরং গণতান্ত্রিক চর্চার জন্যও ক্ষতিকর। একটি সরকার যখন নিজের অপছন্দের কনটেন্ট বা সমালোচনামূলক বক্তব্য দমনে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে, তখন নাগরিকদের স্বাধীন মত প্রকাশের পরিবেশ সংকুচিত হয়। গুগলের প্রতিবেদন দেখায়, অনুরোধ পাঠালেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকার নিজের তথ্য–প্রমাণ যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারেনি। এটি ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে জনগণও জানতে পারছে না কোন কোন কনটেন্ট সরানো হয়েছে বা সরাতে চাওয়া হয়েছে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা যদি থাকে, সরকারেরও থাকা উচিত—এটাই স্বাভাবিক এবং গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ আসলে নতুন কোনো বিষয় নয়। বিশ্বের প্রতিটি দেশ রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা, নিরাপত্তা, উস্কানি বা ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। তবে পার্থক্য থাকে কিভাবে এবং কোন যুক্তিতে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হলো—সমালোচনা কতটা পর্যন্ত অনুমোদিত? রাষ্ট্রের ভুল বা দুর্বলতা তুলে ধরা কি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে? নাকি এই অনুরোধগুলো শুধু অসন্তোষ চাপা দেওয়ার রাজনৈতিক প্রয়াস? এসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর না থাকলে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ন্ত্রণের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারও হতে পারে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রযুক্তিনির্ভর তথ্যযুদ্ধের নতুন বাস্তবতা। এখন আর কেবল রাজনৈতিক মঞ্চে বা সভা–সমাবেশে সমালোচনা হয় না। সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, অনলাইন নিউজ—সব জায়গায় নাগরিকরা মত প্রকাশ করে। সরকারের পছন্দ–অপছন্দ সেখানে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তাই কনটেন্ট অপসারণের সিদ্ধান্তও এখন রাজনৈতিক চাপের চেয়ে বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে জনমতের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের একটি সরঞ্জাম হিসেবে। কিন্তু এ ধরনের প্রবণতা যতই বাড়ে, রাষ্ট্র ততই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে সরে যায়। কারণ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের মাধ্যমে কখনও স্থায়ী সামাজিক স্থিতি অর্জিত হয় না।
গুগলের প্রতিবেদনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অনুরোধগুলো কীভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তারা বলেছে, অনুরোধের বেশির ভাগই “অপর্যাপ্ত বা অস্পষ্ট”। এর মানে, সরকার চাইলে কনটেন্ট সরাতে পারে এমন আইনি কাঠামো আছে, কিন্তু সেই কাঠামো অনুযায়ী প্রমাণ–সমর্থিত অভিযোগ পাঠানো হয়নি। অনুরোধের এই মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে—এগুলো কি দ্রুততা বা রাজনৈতিক তাড়াহুড়োয় তৈরি করা অনুরোধ? নাকি সরকারি সংস্থাগুলো এখনও আইনগত মানদণ্ড অনুসরণে দক্ষতা অর্জন করেনি? সব মিলিয়ে স্পষ্ট করে বলা যায়—কনটেন্ট অপসারণের কাঠামো যতটা শক্তিশালী, তার প্রয়োগ এখনও ততটা সুসংগঠিত নয়।
বাংলাদেশে অনলাইন নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস নতুন নয়। অতীতে একাধিক সরকার অনলাইন কনটেন্ট ব্লক, ওয়েবসাইট বন্ধ বা সামাজিক মাধ্যম সাময়িক নিষ্ক্রিয় করার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো তারা স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং নতুন অধ্যাদেশেও তথ্য প্রকাশের নির্দেশ রাখা হয়েছে। তবুও বাস্তবতা ভিন্ন—মানুষ জানতে পারছে না কনটেন্ট অপসারণের কারণ, তালিকা কিংবা যুক্তিগুলো কী। ফলে সরকারের প্রতি আস্থা কমছে, আর সমালোচনার ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সবশেষে এ প্রশ্নটিই সবচেয়ে বড়—সমালোচনা কি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর, নাকি বরং প্রয়োজনীয়? একটি রাষ্ট্রের নীতি, সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা হলে তা ত্রুটি দূর করতে সাহায্য করে। দমন করলে কেবল অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়। প্রযুক্তিনির্ভর যুগে কণ্ঠরোধ করা আরও কঠিন; মানুষ বিকল্প প্ল্যাটফর্ম খুঁজে নেয়, নতুন পথ তৈরি করে। তাই কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ যতই পাঠানো হোক, সত্যিকারের সমাধান আসে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং সংলাপের মাধ্যমে। সরকারের উচিত হবে অনুরোধের প্রকৃতি, কারণ ও যুক্তি প্রকাশ করা—যাতে জনগণ বুঝতে পারে কোনো কনটেন্ট সরানো আসলেই কি জনস্বার্থে নাকি রাজনৈতিক অস্বস্তি থেকে। স্বচ্ছতার এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না হলে প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর রিপোর্ট আরও বিতর্ক তৈরি করবে এবং সরকার–নাগরিক সম্পর্কের দূরত্ব বাড়াবে। তথ্য লুকিয়ে রাখা, সমালোচনা দমন করা বা অস্পষ্ট আইনি প্রয়োগ—কোনোটিই স্থায়ী সমাধান নয়। বরং খোলা আলোচনার পথই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়, এবং সেই পথেই ভবিষ্যত বাংলাদেশের ডিজিটাল স্বাধীনতা টিকে থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ