আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল কুনার ও নানগারহার প্রদেশে সম্প্রতি আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্প গোটা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৬, কিন্তু মধ্যরাতের অপ্রস্তুত সময়ে আসায় এই ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ হয়ে ওঠে ভয়াবহ। ইতোমধ্যেই মৃতের সংখ্যা ১৪০০ ছাড়িয়েছে, আহতের সংখ্যা ৩১০০-এর বেশি। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো বহু মানুষ আটকে আছেন। পুরো পূর্ব আফগানিস্তান যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রাতের আঁধারে হঠাৎ করে কম্পন শুরু হলে লোকজন দিশেহারা হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। অনেকেই দেয়াল চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু একটি দেশকেই নয়, পুরো অঞ্চলকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। আফগানিস্তানের এই ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশের মতো ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে আবারও আলোচনায় এসেছে নিজেদের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যদি এরকম শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটে, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কী দাঁড়াবে, সেটি সহজেই অনুমান করা যায়। তাই আফগানিস্তানের ট্র্যাজেডি আমাদের জন্যও বড় এক সতর্কবার্তা।
আফগানিস্তানের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, অনেক প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধস ও ভাঙা সড়কের কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হয়েছে। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আহতদের সরানো হলেও এখনো অনেক এলাকায় পৌঁছানো যায়নি। আন্তর্জাতিক সহায়তা সীমিত আকারে পৌঁছাচ্ছে—জাতিসংঘ, রেডক্রস, যুক্তরাজ্য, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, পাকিস্তান ও ইরান সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। তবুও বাস্তবে দুর্গম ভৌগোলিক কারণে ভুক্তভোগীদের কাছে দ্রুত সহায়তা পৌঁছানো যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ এই বিপর্যয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কোনো ত্রাণ বা উদ্ধার দল পাঠানো হয়নি। যদিও ২০২২ সালে আফগানিস্তানে ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়েছিল। এবারও মানবিক সহায়তা পাঠানো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যদি বাংলাদেশেই এরকম ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়, তাহলে আমরা কতটা প্রস্তুত?
বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করলে দেখা যায়, সিলেট ও চট্টগ্রাম উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ (সিসমিক জোন-২), ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চল মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ (সিসমিক জোন-৩) এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ। ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সক্রিয় কয়েকটি ফল্ট লাইন রয়েছে—যেমন দাউকি ফল্ট, সিলেট-চট্টগ্রাম ফল্ট এবং মধুপুর ফল্ট। এদের যেকোনো একটি বড় মাত্রায় নড়েচড়ে উঠলে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটতে পারে।
ঢাকা শহর ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় দুই কোটি মানুষের বসতি, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন, অপরিকল্পিত বহুতল ভবন, সরু গলি, অপর্যাপ্ত খোলা স্থান—সব মিলিয়ে রাজধানী যদি বড় ভূমিকম্পের শিকার হয়, তাহলে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হবে। গবেষণা বলছে, ঢাকায় যদি রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তাহলে লাখ লাখ মানুষ হতাহত হতে পারে এবং নগরের একটি বড় অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।
বাংলাদেশ সরকার গত কয়েক বছরে ভূমিকম্প মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে বিশেষ ভূমিকম্প উদ্ধার ইউনিট গঠন করা হয়েছে। তাদের আধুনিক সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে—যেমন ধ্বংসস্তূপ কাটার যন্ত্র, গ্যাস ডিটেক্টর, সেন্সর, সার্চ ক্যামেরা এবং বিশেষ কুকুর দল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বড় শহরে উদ্ধার দল মোতায়েন রাখা হয়েছে। তাছাড়া সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে দুর্যোগ পরিস্থিতিতে দ্রুত মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে বাস্তবতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ এখনো পূর্ণ প্রস্তুত নয়। বহুতল ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয় না। অনেক পুরোনো ভবন কাঠামোগতভাবে দুর্বল। স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি ঘাটতি রয়েছে। নগরবাসী ভূমিকম্প প্রস্তুতি সম্পর্কে সচেতন নয়—অনেকে জানেই না ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে। স্কুল, অফিস কিংবা বাসাবাড়িতে নিয়মিত মহড়া হয় না। ফলে হঠাৎ করে বড় ভূমিকম্প হলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়বে এবং প্রাণহানি বাড়বে।
বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা কিছু সুপারিশ করে আসছেন—
১. সকল বহুতল ভবনে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কাঠামো পরীক্ষা করে পুনর্নির্মাণ বা ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. রাজধানী ঢাকায় আরও খোলা জায়গা তৈরি করতে হবে, যাতে জরুরি আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়।
৪. স্কুল, কলেজ, অফিস, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া চালু করতে হবে।
৫. সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য গণমাধ্যম ও স্থানীয় সরকার উদ্যোগ নিতে হবে।
৬. স্থানীয় পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গড়ে তুলতে হবে, যারা জরুরি মুহূর্তে উদ্ধার কাজে অংশ নিতে পারবে।
৭. আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার—সবাই ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ, তাই যৌথ মহড়া ও উদ্ধার সহযোগিতা জরুরি।
বাংলাদেশের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো জরুরি চিকিৎসা সেবা। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে হাজার হাজার মানুষ আহত হবে। হাসপাতালের ধারণক্ষমতা সীমিত, চিকিৎসক ও ওষুধের সংকট দেখা দেবে। এ জন্য আগেভাগেই বিকল্প মেডিকেল ক্যাম্প পরিকল্পনা করতে হবে।
প্রযুক্তির দিক থেকেও বাংলাদেশকে আরও উন্নত হতে হবে। ভূমিকম্প পূর্বাভাস প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। জাপান বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে ভূমিকম্পের আগে সতর্কবার্তা দেওয়া সম্ভব হয়, কিন্তু বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থা নেই। আমাদের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলো আরও উন্নত করতে হবে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তথ্য বিনিময় বাড়াতে হবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জনসচেতনতা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কার্যকর হয় না। প্রত্যেক পরিবারের সদস্যদের জানতে হবে ভূমিকম্প হলে কীভাবে নিরাপদে বের হতে হবে, কোথায় আশ্রয় নিতে হবে, কীভাবে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে।
আফগানিস্তানের এই ভূমিকম্প আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, প্রস্তুতি ছাড়া একটি দেশ কতটা অসহায় হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মুখে থেকেও এখনো পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে পারেনি। কিছু অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। বড় ভূমিকম্প হলে শুধু সরকারি সংস্থার ওপর নির্ভর করলে চলবে না; সমন্বিত পরিকল্পনা, কঠোর বাস্তবায়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমেই ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।
আফগানিস্তানের পাহাড়ি গ্রামগুলোর ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা মানুষের আর্তনাদ যেন আমাদের সতর্ক করে দেয়—ভূমিকম্প ঠেকানো যায় না, কিন্তু প্রস্তুত থাকলে জীবন রক্ষা করা সম্ভব। বাংলাদেশের জন্য এখনই সময় নিজের ঘাটতিগুলো পূরণ করার, নইলে আমরাও একদিন একই ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি।
আপনার মতামত জানানঃ