আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হেরাতে নতুন করে নারীদের চলাচল ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ওপর আরোপ করা বিধিনিষেধ আবারও প্রমাণ করল—একটি সমাজে রাজনৈতিক পরিবর্তন যত দ্রুতই আসুক, তার প্রভাব সবচেয়ে গভীরভাবে আঘাত করে সাধারণ মানুষের জীবনে। বিশেষ করে নারীদের জীবনে। আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সহায়তা সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা শুধু এক অঞ্চলের পরিস্থিতি নয়; বরং পুরো আফগানিস্তানে নারীদের অবস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী হেরাতের সরকারি হাসপাতালে নারী রোগী, তাদের অভিভাবক এবং চিকিৎসাকর্মীদের জন্য বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নারীদের পূর্ণ শরীর ও মুখ ঢেকে রাখা ইসলামী পর্দা প্রথা অবশ্য নতুন নয়, কিন্তু এবার এর প্রয়োগ যেভাবে জনজীবনকে সংকীর্ণ করে তুলছে, তা মানবাধিকারকর্মীদের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টদেরও গভীরভাবে চিন্তিত করে তুলেছে।
৫ নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া এই সিদ্ধান্তটি প্রথম নজরে শুধু পোশাকবিধি মনে হলেও, এর পরিণতি আরও গভীর ও মারাত্মক। এমএসএফ-এর আফগানিস্তান প্রোগ্রাম ম্যানেজার সারা শাতো খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, এই বিধিনিষেধ নারীদের জীবনকে আরও সীমাবদ্ধ করছে, এমনকি জরুরি চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রেও বাধা তৈরি করছে। তাঁর বক্তব্য থেকে যে বাস্তবতা উঠে আসে তা হলো—স্বাস্থ্যসেবা এমন একটি অধিকার যা সংকটময় সময়ে দ্রুতপ্রাপ্তি জরুরি। কিন্তু বোরকা বাধ্যতামূলক হওয়ায় বহু নারী হাসপাতালের গেটে থেমে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ভয় পাচ্ছেন তালেবান সদস্যদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে, কেউ আবার বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। চিকিৎসার ক্ষেত্রে সামান্য বিলম্বও কোনো রোগীর জন্য জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে। হেরাতে যে প্রথম কয়েকদিনেই জরুরি রোগী ভর্তি ২৮ ভাগ কমে গেছে—এটি একটি অ্যালার্মিং সিগন্যাল।
এমএসএফ জানিয়েছে যে তারা হেরাত আঞ্চলিক হাসপাতালের শিশু বিভাগে সহায়তা দিচ্ছে। শিশু রোগীরা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, এবং চিকিৎসা বিলম্বিত হওয়া মানেই অধিক ঝুঁকি। কিন্তু এই নতুন নিয়ম শিশুদের চিকিৎসা পাওয়ার পথেও বাধা সৃষ্টি করছে, কারণ মা বা নারী অভিভাবকের বোরকা না থাকলে তাদের প্রবেশেই বাধা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীরাও যদি একই বাধার মুখে পড়েন, তাহলে হাসপাতালের কার্যক্রমই অচল হয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ, সরকার যে সিদ্ধান্তকে ধর্মীয় মূল্যবোধের নামে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে চাচ্ছে, তা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।
তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। সরকারের নৈতিকতা প্রচার মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম খাইবার বলেন, এই খবর সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং তাদের অবস্থান কেবল হিজাব পরিধানের ওপর। তারা দাবি করছে, বোরকা বাধ্যতামূলক নয়, বরং সাধারণ হিজাবই যথেষ্ট। কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা এসব বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠন এবং এমএসএফ-এর মতো প্রতিষ্ঠিত সংস্থার প্রতিবেদনগুলোতে একের পর এক রোগী, চিকিৎসাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে যেখানে তারা স্পষ্টভাবে বলেছেন—হেরাতের হাসপাতালে বোরকা পরা ছাড়া প্রবেশই সম্ভব হচ্ছে না।
এখানে বিষয়টি কেবল ধর্মীয় পোশাকবিধির নয়; বরং নিয়ন্ত্রণ ও ভীতির রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। আফগানিস্তানে ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নারীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চলাচল এবং স্বাধীনতার ওপর ধারাবাহিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নারীরা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অধিকার হারিয়েছে, বেশিরভাগ সরকারি চাকরি থেকে বাদ পড়েছে, পার্ক ও পর্যটনস্থলেও তাদের প্রবেশ বন্ধ হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় এবার স্বাস্থ্যসেবা—যা নারীদের জন্য সবচেয়ে জীবিকার এবং মর্যাদার লড়াইয়ের ক্ষেত্র—সেটিও তালেবান নীতিমালার কঠোর নজরদারিতে চলে এসেছে।
নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা আফগান সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেছেন। তারা পরিবার-সংস্কৃতি এবং পুরুষ-নারী মেলামেশার সীমাবদ্ধতার কারণে নারী রোগীদের জন্য অপরিহার্য ছিল। কিন্তু বোরকা বাধ্যতামূলক হওয়ায় অনেক স্বাস্থ্যকর্মী নিজেই কর্মস্থলে যেতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তারা জানাচ্ছেন, দীর্ঘ সময় ধরে বোরকা পরে কাজ করা কেবল অস্বস্তিকরই নয়, বরং চিকিৎসা কাজে শারীরিকভাবে অসুবিধাও তৈরি করে। শিশু বিভাগের মতো সংবেদনশীল স্থানে দ্রুত সেবা দিতে হয়, কিন্তু বোরকা পরার কারণে চলাফেরা কমে যায়, যোগাযোগ কঠিন হয়, গ্লাভস বা চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অসুবিধা তৈরি হয়। নারীদের জন্য এটি যেন আরেকটি শেকল।
তালেবান সরকারের দাবি—এই নিয়ম নারীদের নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু নিরাপত্তা তখনই অর্থবহ যখন তা মানুষের স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। যদি নিরাপত্তার নামে মানুষকে চিকিৎসা গ্রহণ থেকেও বঞ্চিত করা হয়, তাহলে সেই নিরাপত্তার ধারণাই প্রশ্নবিদ্ধ। মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা অন্যতম। রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানুষকে সেবা দেওয়া; বাধা তৈরি করা নয়।
হেরাতের এই ঘটনাটি আরও একটি বাস্তবতাকে সামনে আনে—বাধ্যতামূলক পোশাকবিধি আরোপ করা শুধু নারীর স্বাধীনতাকেই খর্ব করে না; বরং জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামোকে দুর্বল করে। নারীরা চিকিৎসা নিতে না পারলে মৃত্যু হার বাড়বে, অপুষ্টি বৃদ্ধি পাবে, মাতৃমৃত্যুর হার আরও খারাপ হবে। শিশু মৃত্যুর হার ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানে বিশ্বের অন্যতম উচ্চ হারের মধ্যে রয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞা সেই সংকটকে আরও তীব্র করবে।
আন্তর্জাতিক মহল এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তান মানবিক সহায়তার ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। এমএসএফের মতো সংগঠন ঝুঁকি নিয়ে, অল্প সম্পদে, মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু যদি তাদের কাজেই বাধা সৃষ্টি হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। হেরাতের অভিজ্ঞতা স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, মানবিক সহায়তা সংস্থা যখনই সংকটের কথা বলে, সরকার তা অস্বীকারের পথ বেছে নেয়। কিন্তু অস্বীকার করলে বাস্তবতা পাল্টে যায় না। রোগীরা যে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, সেই কষ্টই সত্য।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রথম শর্ত হলো বাস্তব সমস্যাকে স্বীকার করা। বোরকা পরিধানকে বাধ্যতামূলক করার ফলে যে নারীরা চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন, তা মেনে নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে। ধর্মীয় বিধান মানা ও মানবিক সেবাপ্রাপ্তি—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনা জরুরি। আফগানিস্তানের নারীরা বারবার প্রমাণ করেছেন, তারা দেশের উন্নয়নে অপরিহার্য। তাদের স্বাধীনতা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি সীমিত করা মানে একটি জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া।
পরিশেষে বলা যায়, হেরাতের এই ঘটনা কেবল একটি হাসপাতালের প্রবেশগেটের গল্প নয়; এটি পুরো আফগান সমাজের সংগ্রামের প্রতীক। নারীর অধিকার, ধর্মীয় রীতি, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং মানবিক জীবনের সংঘাত এখানে এক সুতোয় গাঁথা। তালেবানের নিয়ম একদিকে নারীর দেহ ঢাকতে বলছে, অন্যদিকে তাদের জীবনের দরজা সংকীর্ণ করে তুলছে। কিন্তু যত বাধাই আসুক, মানবাধিকারের প্রশ্ন কখনো চাপা পড়ে না। আন্তর্জাতিক সংগঠন, মানবিক উদ্যোগ এবং আফগান জনগণের চাওয়া–পাওয়া মিলেই একদিন হয়তো সেই স্বাধীনতার বাতাস ফিরে আসবে। আজ যারা হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাদের কণ্ঠই একদিন পরিবর্তনের পথ খুলে দেবে—এই আশাই মানবতার শেষ আলো হয়ে থাকে।
আপনার মতামত জানানঃ