১৯৯৮ সালে যমুনা সেতুর উদ্বোধনের দিনটিকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগ, অর্থনৈতিক প্রবাহের গতি বৃদ্ধি এবং জাতীয় সংহতির প্রতীক হিসেবে সেতুটি তখন ছিল গর্বের বিষয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সেতুই যমুনা নদী ও নদীপাড়ের মানুষের জন্য এক গভীর ক্ষতের নাম হয়ে উঠেছে। উন্নয়নের যে কাঠামো যোগাযোগ সহজ করেছে, সেটিই ধীরে ধীরে নদীর স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ ভেঙে দিয়ে হাজারো মানুষকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে, বদলে দিয়েছে ভূগোল, জীবিকা ও সামাজিক সম্পর্কের মানচিত্র।
টাঙ্গাইলের চরপলি গ্রামের হাটে দাঁড়ালে এখনও স্বাভাবিক জীবনের ছবি চোখে পড়ে। সপ্তাহে দুই দিন মানুষ আসে, কেনাবেচা হয়, শিশুদের কোলাহলে ভরে ওঠে চারপাশ। কিন্তু এই দৃশ্যের নিচে চাপা পড়ে আছে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আর অসহায়তার গল্প। হাজরাত আলীর মতো বৃদ্ধরা জানেন, এই গ্রাম আগেও ছিল, কিন্তু ছিল অন্য জায়গায়। নদী তখন অনেক দূরে। যমুনা সেতু ও তার সঙ্গে যুক্ত গাইড বান্ড নির্মাণের পর থেকেই নদীর চরিত্র বদলাতে শুরু করে। যে সুরক্ষাবাঁধ সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষার জন্য উজানে হওয়ার কথা ছিল, সেটি সরিয়ে আনা হয় গ্রামীণ টাঙ্গাইল অংশে। এই সিদ্ধান্তের ফলেই নদীর চাপ পড়ে একদিকে, আর শুরু হয় ভয়াবহ ভাঙন।
যমুনা প্রকৃতিগতভাবেই একটি অস্থির নদী। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সে তার পথ বদলেছে, নতুন চর তৈরি করেছে, আবার সেগুলো ভেঙে নিয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তন ছিল একটি স্বাভাবিক ছন্দের মধ্যে। সেতু নির্মাণের পর সেই ছন্দ ভেঙে যায়। নদীকে সংকুচিত করে একটি নির্দিষ্ট চ্যানেলে বেঁধে ফেলা হয়। এতে উজানে পানির গতি কমে গিয়ে বিপুল পরিমাণ পলি জমতে থাকে। ধীরে ধীরে সেখানে গড়ে ওঠে স্থায়ী বালুচর, যাকে অনেক গবেষক ‘মানবসৃষ্ট মরুভূমি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর ভাটিতে, সংকুচিত পথ পেরিয়ে বেরিয়ে আসা পানি প্রবল চাপে নদীতীর আছড়ে পড়ে। টাঙ্গাইলের একের পর এক গ্রাম, ফসলি জমি আর বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হতে থাকে।
এই ভাঙনের শিকার মানুষদের জন্য ঘর হারানো কোনো একক দুর্ঘটনা নয়, বরং জীবনের পুনরাবৃত্ত বাস্তবতা। মোকাদ্দেস মিয়ার মতো মানুষ একবার নয়, বহুবার নদীর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন। আজ যে জায়গায় ঘর তুলেছেন, কাল সেটিও থাকবে কি না—এই অনিশ্চয়তা নিয়েই তাদের দিন কাটে। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক পরিবার সাত থেকে আটবার পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই বাস্তুচ্যুতি শুধু বসতভিটা নয়, পরিচয়, সামাজিক বন্ধন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকেও ভেঙে দেয়।
উজানের সিরাজগঞ্জে চিত্র আবার ভিন্ন। সেখানে একসময় প্রবল স্রোতের যমুনা এখন বিস্তীর্ণ বালুচরে পরিণত হয়েছে। বর্ষাকালেও অনেক জায়গায় পানি দেখা যায় না। সেতুর আশপাশে নদী এতটাই সংকুচিত যে ছোট নৌকায় মোটরসাইকেল পারাপার সম্ভব হয়। একসময় যে ‘চায়না বাঁধ’ শহর রক্ষার প্রতীক ছিল, আজ তার পাশেই গড়ে উঠেছে স্থায়ী চর। সেখানে চাষ হচ্ছে, জমি লিজ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু নদীর প্রাণ যেন নেই। জেলেরা জানান, মাছ ধরা নিষিদ্ধ এলাকা বাড়ায় এবং পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় তাদের পেশা টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
স্যাটেলাইট চিত্র ও ভৌত মডেলিং এই পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দিয়েছে। গত চার দশকে যমুনার তীর কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত সরে গেছে। হাজার হাজার হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। নদী স্বাভাবিকভাবেই ব্রেইডেড—অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পলি ও পানি বহন করে। এই বিশৃঙ্খলাই তার শক্তি। কিন্তু সেতু ও নদীশাসনের কাঠামো নদীকে একটি সরু গলিতে আটকে দিয়েছে। এর ফলে উজানে পলি জমে নদী মরে যাচ্ছে, আর ভাটিতে তীব্র ভাঙন চলছে।
এই প্রক্রিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ভয়াবহ। উজানে চরজমিতে কৃষি কিছুটা বেড়েছে। ভুট্টা, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুনের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই সাফল্য ক্ষণস্থায়ী। প্রতি বর্ষায় বড় অংশের ফসল নষ্ট হয়। ভাটিতে মানুষ ফসল ফলানোর সুযোগই হারাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৎস্য খাত। ইলিশসহ দেশীয় মাছের প্রজনন কমে গেছে। হাজারো জেলে পরিবার বিকল্প জীবিকার খোঁজে বাধ্য হচ্ছে পেশা বদলাতে।
যমুনা সেতু প্রকল্পে সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায় হলো পুনর্বাসন। আন্তর্জাতিক অর্থায়নে নির্মিত এই প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অধিকাংশই ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পায়নি। গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বীকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রায় ৮০ শতাংশই যথাযথ পুনর্বাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যারা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে, তাদের অনেককেই ঘুষ দিতে হয়েছে। চরবাসীদের অধিকাংশের জমির কাগজ না থাকায় তারা দালাল ও ভূমি কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা শোষণকে আরও গভীর করেছে।
এখনও সরকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো জিওব্যাগ, ড্রেজিং আর তথাকথিত নদীশাসনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ অনেক সময়ই অস্থায়ী ও ‘দৃষ্টিনন্দন’ সমাধান হয়ে থেকে যাচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যেই সেগুলো আবার পলিতে ভরে অকার্যকর হয়ে পড়ে। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলাদা আলাদা বাঁধ দিয়ে নদীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। নদীকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলার সুযোগ না দিলে বিপর্যয় আরও বাড়বে।
যমুনা শুধু একটি নদী নয়, এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের অংশ। হাজার হাজার বছর ধরে এই নদী ও তার মতো নদীগুলো পলি বয়ে এনে এই ভূখণ্ড গড়ে তুলেছে। সেই বাস্তবতা উপেক্ষা করে উন্নয়ন পরিকল্পনা করলে সেতু দাঁড়ালেও নদী মরে যাবে। গবেষকদের সতর্কতা তাই স্পষ্ট—সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা ছাড়া বিকল্প নেই। নইলে একদিন যমুনা সেতু শুধু একটি অবকাঠামো হয়ে থাকবে, যার নিচে আর কোনো নদী থাকবে না, থাকবে শুধু বালু আর হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্মৃতি।
আপনার মতামত জানানঃ