দক্ষিণ ইটালির পাহাড়ঘেরা এক নির্জন এলাকায়, পাথরের ভেতর লুকিয়ে থাকা একটি প্রাচীন সমাধিস্থল হঠাৎ করেই নাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের ইতিহাস, নৈতিকতা ও পারিবারিক কাঠামো নিয়ে আমাদের চেনা ধারণাগুলোকে। গ্রোট্টা ডেল্লা মোনাকা—ক্যালাব্রিয়ার এই সমাধিক্ষেত্রটি হাজার হাজার বছর ধরে নিশ্চুপ ছিল। কিন্তু আধুনিক ডিএনএ বিশ্লেষণের আলোয় সেখানে শুয়ে থাকা কঙ্কালগুলো যেন হঠাৎ কথা বলতে শুরু করেছে। সেই কথার ভাষা অস্বস্তিকর, বিস্ময়কর এবং গভীরভাবে মানব ইতিহাসের অন্ধকার দিকের সাক্ষ্য।
প্রত্নতত্ত্ববিদ ও জিনতত্ত্ববিদদের একটি জার্মান দল এই সমাধিস্থলে সংরক্ষিত দেহাবশেষ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন মানুষের জিনগত উৎস ও পারিবারিক সম্পর্ক বোঝার উদ্দেশ্যে। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮০ সাল থেকে শুরু করে প্রায় খ্রিস্টীয় ১৭৮০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ চার হাজার বছরের ব্যবধানে এখানে মানুষের কবর দেওয়া হয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহৃত হওয়ায় কবরের ভেতরে কঙ্কালগুলো ভেঙে গেছে, একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। তবু আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বিজ্ঞানীরা ২৩ জন ব্যক্তির ডিএনএ আলাদা করে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন।
এই বিশ্লেষণ থেকেই সামনে আসে এক চাঞ্চল্যকর সত্য। ওই ২৩ জনের মধ্যে একজন কিশোরের জিনগত গঠন এমন একটি সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়, যা আজকের সমাজে শুধু নিষিদ্ধই নয়, গভীরভাবে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত—সে কিশোরের জন্ম হয়েছিল তার বাবা ও কন্যার যৌনমিলনের ফলে। অর্থাৎ, তার বাবা ছিলেন একই সঙ্গে তার মায়েরও বাবা। বিজ্ঞানীদের মতে, এখন পর্যন্ত মানুষের ইতিহাসে এটিই পিতা-কন্যার যৌনসম্পর্ক ও তার ফলে সন্তান জন্মানোর সবচেয়ে প্রাচীন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নিদর্শন।
এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন একটি বিশেষ জিনগত সূচক—‘রানস অফ হোমোজাইগোসিটি’ বা আরওএইচ। সহজভাবে বললে, বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া জিনের মধ্যে কতটা মিল রয়েছে, তা দিয়ে বোঝা যায় তারা পরস্পরের কতটা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। পরিবারের বাইরের দুই মানুষের মধ্যে সন্তান জন্মালে জিনগত বৈচিত্র্য বেশি থাকে, ফলে আরওএইচ কম হয়। কিন্তু নিকট আত্মীয়দের মধ্যে মিলনে জন্মানো সন্তানের ক্ষেত্রে এই আরওএইচ অস্বাভাবিকভাবে বেশি হয়। গ্রোট্টা ডেল্লা মোনাকার ওই কিশোরের ডিএনএ-তে আরওএইচ-এর মাত্রা ছিল গবেষণায় পাওয়া সবার মধ্যে সর্বোচ্চ। পরবর্তী বিশ্লেষণেই নিশ্চিত হন বিজ্ঞানীরা—এটি ‘প্রথম ডিগ্রি মিলন’, অর্থাৎ সরাসরি অভিভাবক ও সন্তানের মধ্যকার যৌন সম্পর্কের ফল।
এই তথ্য শুধু একটি কঙ্কালের পরিচয় উন্মোচন করেনি, বরং গোটা সমাধিস্থল সম্পর্কেও নতুন প্রশ্ন তুলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ওই ২৩ জনের প্রায় সবার মধ্যেই আরওএইচ তুলনামূলকভাবে বেশি। অর্থাৎ, এই গোষ্ঠীর মধ্যে আত্মীয়তার ভেতরেই বিয়ে বা যৌনসম্পর্কের প্রবণতা ছিল। তবে পিতা-কন্যার সম্পর্কটি ছিল সবচেয়ে চরম এবং বিরল। আশ্চর্যের বিষয়, ওই কিশোরের মধ্যে বড় কোনো জিনগত রোগ বা বিকৃতি ধরা পড়েনি, যদিও এমন সম্পর্কে জন্মানো সন্তানের ক্ষেত্রে সাধারণত জিনগত সমস্যার ঝুঁকি বেশি থাকে।
সমাধিস্থলের বিন্যাসও গবেষকদের কৌতূহল বাড়িয়েছে। অনেক কবরেই দেখা গেছে, প্রিয়জনদের পাশাপাশি সমাধিস্থ করা হয়েছে। কোথাও মা ও মেয়ের কবর পাশাপাশি, কোথাও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পাশেই কিশোরের দেহাবশেষ। ওই কিশোরের বাবার কবর ছিল তার পাশেই, কিন্তু মায়ের—অর্থাৎ বাবার কন্যার—কবরের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এই অনুপস্থিতি নানা জল্পনার জন্ম দিয়েছে। তিনি কি অন্য কোথাও সমাধিস্থ? না কি সামাজিক বা পারিবারিক কারণে তাকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল? নাকি তার মৃত্যু ঘটেছিল অন্য কোনো পরিস্থিতিতে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আপাতত অজানা।
পরিবারের মধ্যে যৌনসম্পর্ক আধুনিক সমাজে যতটা অস্বাভাবিক ও নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয়, অতীতে বিষয়টি ততটা একরৈখিক ছিল না—এ কথা বিজ্ঞানীরা বহু আগেই জানতেন। প্রাচীন মিশরের রাজপরিবারে ভাই-বোনের বিয়ে ছিল ক্ষমতা ও সম্পত্তি ধরে রাখার কৌশল। আয়ারল্যান্ডের প্রস্তর যুগের এক শাসকের দেহাবশেষ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তার বাবা-মা ছিলেন সহোদর। নিয়ানডারথালদের মধ্যেও আত্মীয়দের মধ্যে মিলনের বহু প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল ভাই-বোন বা কাছাকাছি আত্মীয়দের মধ্যে, যাকে বিজ্ঞানীরা ‘দ্বিতীয় ডিগ্রি’ সম্পর্ক বলেন। অভিভাবক ও সন্তানের মধ্যকার যৌনসম্পর্ক—‘প্রথম ডিগ্রি মিলন’—এর প্রমাণ অত্যন্ত বিরল।
এই কারণেই গ্রোট্টা ডেল্লা মোনাকার আবিষ্কার এত গুরুত্বপূর্ণ এবং অস্বস্তিকর। এটি দেখায় যে, প্রায় ৩,৭০০ বছর আগে ইউরোপের এক সাধারণ মানুষের সমাজেও এমন চরম সম্পর্ক ঘটেছিল। গবেষকেরা জোর দিয়ে বলেছেন, এই সমাধিস্থলে রাজপরিবার বা অভিজাতদের কবর নেই। এগুলো ছিল সাধারণ মানুষের কবর। ফলে রাজবংশের মতো সম্পত্তি বা ক্ষমতা রক্ষার যুক্তি এখানে খাটে না। তাহলে কেন এমন একটি সম্পর্ক ঘটেছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভলিউশনারি অ্যানথ্রোপলজির অধ্যাপিকা অ্যালিস মিটনিক মনে করেন, ঘটনাটি সম্ভবত ব্যতিক্রমী ছিল। এটি কোনো সামাজিক রীতি নয়, বরং হয়তো ব্যক্তিগত সহিংসতা, ক্ষমতার অপব্যবহার বা জোরপূর্বক সম্পর্কের ফল। তবে কঙ্কাল ও ডিএনএ থেকে এমন সামাজিক বাস্তবতার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া কঠিন। ইতিহাস এখানে নীরব, শুধু ফলাফলটুকু রেখে গেছে।
এই আবিষ্কার আমাদের সামনে আরও বড় একটি প্রশ্ন তোলে—নৈতিকতা কি চিরকাল একই ছিল? আজ যে সম্পর্ককে আমরা ঘৃণ্য ও অপরাধ হিসেবে দেখি, তা কি অতীতেও একইভাবে দেখা হতো? নাকি সামাজিক কাঠামো, জনসংখ্যার চাপ, বিচ্ছিন্নতা বা সাংস্কৃতিক বাস্তবতা মানুষকে ভিন্ন সিদ্ধান্তে ঠেলে দিত? গ্রোট্টা ডেল্লা মোনাকার মানুষরা হয়তো একটি ছোট, বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর অংশ ছিলেন, যেখানে বহির্বিবাহের সুযোগ সীমিত ছিল। তবে তা হলেও পিতা-কন্যার সম্পর্ক এতটাই চরম যে বিজ্ঞানীরাও একে ‘বিরল’ বলেই আখ্যা দিয়েছেন।
এই গবেষণার আরেকটি দিক হলো আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষমতা। কয়েক হাজার বছর পুরনো ভাঙা কঙ্কাল থেকে আজ আমরা শুধু লিঙ্গ বা বয়সই নয়, মানুষের পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক রীতি এমনকি নিষিদ্ধ ইতিহাসও উন্মোচন করতে পারছি। ডিএনএ যেন সময়ের ওপার থেকে উঠে আসা এক নিরপেক্ষ সাক্ষী, যা কোনো নৈতিক বিচার করে না, শুধু সত্যটুকু তুলে ধরে।
তবে সেই সত্যের ভার বহন করা সহজ নয়। গ্রোট্টা ডেল্লা মোনাকার ওই কিশোরের গল্প কোনো লিখিত ইতিহাসে নেই, কোনো কিংবদন্তিতে নেই। তার জীবন, তার জন্মের পরিস্থিতি, তার মায়ের যন্ত্রণা—সবই অজানা। শুধু জানা যায়, সে এক এমন সম্পর্কের ফল, যা আজকের দৃষ্টিতে ভয়াবহ। এই নীরবতা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে—ইতিহাস শুধু বিজয় আর সভ্যতার গল্প নয়, এর গভীরে লুকিয়ে আছে নিপীড়ন, সহিংসতা এবং মানুষের অন্ধকার প্রবৃত্তির চিহ্ন।
এই আবিষ্কার তাই শুধু প্রত্নতত্ত্ব বা জিনতত্ত্বের সাফল্য নয়, এটি এক আয়না। সেই আয়নায় আমরা দেখি, মানুষ হিসেবে আমরা কোথা থেকে এসেছি, কী ধরনের সমাজ পেরিয়ে আজকের নৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে। গ্রোট্টা ডেল্লা মোনাকার পাথুরে সমাধিতে শুয়ে থাকা কিশোর আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের ইতিহাস যত পুরনো, ততটাই জটিল ও অস্বস্তিকর। আর সেই ইতিহাস বোঝার সাহস না থাকলে, আমরা নিজেদের বর্তমানকেও পুরোপুরি বুঝতে পারব না।
আপনার মতামত জানানঃ