আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সাম্প্রতিক মন্তব্য আবারও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সংবেদনশীল ভূরাজনৈতিক ও জনসংখ্যাগত বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে। একটি সরকারি অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি যে ভাষায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তা শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা উদ্বেগ, ভয় ও কৌশলগত হিসাব-নিকাশের প্রতিফলন হিসেবেও দেখা হচ্ছে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, আসামে যদি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষের সংখ্যা আরও ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তাহলে রাজ্যটি ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’। এই মন্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে—ভারতের ভেতরে যেমন, তেমনি বাংলাদেশেও।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মা দাবি করেছেন, তিনি গত পাঁচ বছর ধরেই এই বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করে আসছেন। তাঁর বক্তব্যে সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হলো এই দাবি যে, আসামের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এই সংখ্যাটি নিয়ে বহু বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন তুলেছেন। সরকারি আদমশুমারি, ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) এবং বিভিন্ন গবেষণায় অভিবাসনের বিষয়টি স্বীকৃত হলেও, ৪০ শতাংশের মতো উচ্চ হার নিয়ে ঐকমত্য নেই। তবু এই সংখ্যাটিই রাজনৈতিক বক্তব্যে বারবার উঠে আসছে, কারণ এটি ভয় ও অনিশ্চয়তার অনুভূতিকে আরও প্রবল করে তোলে।
আসাম দীর্ঘদিন ধরেই অভিবাসন প্রশ্নে উত্তপ্ত। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এই অঞ্চলে জনসংখ্যাগত পরিবর্তন শুরু হয়। চা-বাগানের শ্রমিক আনা, কৃষিকাজের জন্য মানুষ বসতি গড়া, এবং পরে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ—সব মিলিয়ে আসামের সামাজিক কাঠামো বারবার বদলেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়, যার একটি বড় অংশ আসে আসামে। যুদ্ধের পর অনেকেই ফিরে গেলেও, অনেকে থেকে যায়। এই ইতিহাসই আজকের রাজনৈতিক বিতর্কের পটভূমি।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বক্তব্য নতুন নয়, কিন্তু সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা কারণে আলোচনায়। সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য, পানি বণ্টন, এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা—সবকিছু মিলিয়ে সম্পর্কটি জটিল। এর মধ্যেই বাংলাদেশের সদ্য গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। তিনি বলেন, ভারত যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, তাহলে ঢাকার উচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করে রাখা এবং সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়া। এই মন্তব্য ভারতের রাজনৈতিক মহলে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বক্তব্য মূলত এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়াতেই এসেছে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, আসাম ও গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত কতটা স্পর্শকাতর অবস্থানে রয়েছে। ‘চিকেন’স নেক’ নামে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডরের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের ওই নেতা যেমন ভারতের ভৌগোলিক দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তেমনি শর্মা জনসংখ্যাগত পরিবর্তনকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন হিসেবে তুলে ধরছেন। এই দুই ধরনের বক্তব্যই বাস্তবে রাজনৈতিক চাপ তৈরির কৌশল।
তবে প্রশ্ন হলো, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন কি সত্যিই একটি রাজ্যকে অন্য দেশের অংশ বানিয়ে দিতে পারে? আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সীমান্ত নির্ধারিত হয় আন্তর্জাতিক আইন, কূটনীতি ও সামরিক শক্তির মাধ্যমে, শুধু জনসংখ্যার অনুপাত দিয়ে নয়। তবু দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে জনসংখ্যা ও পরিচয়ের রাজনীতি অত্যন্ত শক্তিশালী। ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের নজির এখানে আছে। সেই স্মৃতিই রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে বারবার ফিরে আসে।
আসামের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এই বক্তব্যের প্রভাব গভীর। রাজ্যের বহু আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই আশঙ্কা করে আসছে যে, অভিবাসনের কারণে তাদের ভূমি, ভাষা ও রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আসাম আন্দোলন, ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তি, এবং সাম্প্রতিক এনআরসি প্রক্রিয়া—সবই এই আশঙ্কার ফল। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সেই উদ্বেগকেই রাজনৈতিক ভাষা দিচ্ছেন, যদিও তাঁর বক্তব্যের কড়া শব্দচয়ন পরিস্থিতিকে আরও মেরুকৃত করছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়, তাদের বড় একটি অংশ কয়েক দশক ধরে আসামে বসবাস করছে। তারা কৃষি, শ্রম ও স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নাগরিকত্ব, ভোটাধিকার ও সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে তাদের জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতার এমন বক্তব্য তাদের নিরাপত্তাবোধকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। ইতিহাস বলছে, এই ধরনের বক্তব্য কখনো কখনো সহিংসতার পথও তৈরি করে।
বাংলাদেশের দিক থেকেও বিষয়টি স্পর্শকাতর। ঢাকার পক্ষ থেকে সাধারণত বলা হয়, অবৈধ অভিবাসন একটি অতিরঞ্জিত ইস্যু, এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যার দায় বাংলাদেশের ওপর চাপানো ঠিক নয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন করার অভিযোগ বারবার অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের কিছু নেতার উসকানিমূলক বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্ককে অপ্রয়োজনীয়ভাবে জটিল করে তোলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের মন্তব্য আসলে ঘরোয়া রাজনীতির জন্য বেশি কার্যকর। আসামে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলতে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অভিবাসন ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্নকে সামনে আনছেন। একইভাবে বাংলাদেশেও কিছু রাজনৈতিক শক্তি ভারতের বিরুদ্ধে কড়া ভাষা ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চায়। বাস্তব কূটনীতিতে অবশ্য দুই দেশই জানে যে, পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।
উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিশাল। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সংযোগস্থল, ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির কেন্দ্রবিন্দু। একই সঙ্গে এটি চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সন্নিকটে অবস্থিত। এই অঞ্চলে অস্থিরতা শুধু ভারত বা বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য উদ্বেগের বিষয়। তাই এখানে জনসংখ্যা, পরিচয় ও নিরাপত্তা নিয়ে যেকোনো বক্তব্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দেওয়া প্রয়োজন।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বক্তব্য হয়তো তাঁর সমর্থকদের কাছে দৃঢ় নেতৃত্বের উদাহরণ, কিন্তু সমালোচকদের মতে এটি বাস্তবসম্মত সমাধানের বদলে ভয়ভিত্তিক রাজনীতিকে উসকে দেয়। অভিবাসন একটি জটিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়, যা শুধু সীমান্ত পাহারা বা কড়া বক্তব্য দিয়ে সমাধান করা যায় না। এর জন্য দরকার আঞ্চলিক সহযোগিতা, উন্নয়ন, এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
সব মিলিয়ে, আসাম ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের অংশ হয়ে যাবে’—এই ধরনের মন্তব্য বাস্তবতার চেয়ে প্রতীকী অর্থেই বেশি শক্তিশালী। এটি একটি সতর্কবার্তা, একটি রাজনৈতিক স্লোগান, এবং একই সঙ্গে একটি বিতর্কের জন্মদাতা। কিন্তু এই বিতর্ক যদি সংলাপ ও সমাধানের পথে না গিয়ে উত্তেজনা ও অবিশ্বাস বাড়ায়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুই দেশের সাধারণ মানুষই। ইতিহাস সাক্ষী, দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনামূলক কথার চেয়ে দায়িত্বশীল নীরবতা ও বাস্তবসম্মত সহযোগিতাই দীর্ঘমেয়াদে বেশি ফলপ্রসূ।
আপনার মতামত জানানঃ