ওয়াশিংটনের দক্ষিণ এশিয়া নীতিতে এক নাটকীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তিকে এসে। দীর্ঘদিন ধরে যে যুক্তরাষ্ট্র ‘ভারত প্রথম’ নীতিকে সামনে রেখে এ অঞ্চলের কৌশল সাজিয়ে আসছিল, সেই ধারা হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিতে এখন পাকিস্তান উঠে এসেছে নতুন গুরুত্ব নিয়ে। এই পরিবর্তন কেবল কূটনৈতিক সৌজন্য বা সাময়িক কৌশলগত সমন্বয় নয়; বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি বড় পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যার প্রভাব আগামী কয়েক বছর ধরে টের পাওয়া যাবে।
২০২৫ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল শীতল ও সন্দেহে ভরা। ওয়াশিংটনের চোখে ইসলামাবাদ তখনো ছিল এক অবিশ্বস্ত অংশীদার—তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, সন্ত্রাসবাদ দমনে দ্বিচারিতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে যে দেশের ওপর ভরসা করা কঠিন। পাকিস্তানের অর্থনীতি তখনো ভয়াবহ ২০২২-২৩ সালের বন্যার ক্ষত সামলে ওঠার চেষ্টা করছিল। সামান্য প্রবৃদ্ধি এলেও বৈদেশিক ঋণের বোঝা ও মুদ্রাস্ফীতির চাপ দেশটিকে দুর্বল করে রেখেছিল। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা তখন পাকিস্তানকে একপ্রকার ‘কৌশলগত বোঝা’ হিসেবেই দেখতেন।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল তুলনামূলকভাবে উষ্ণ। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারতকে দেখা হচ্ছিল প্রধান স্তম্ভ হিসেবে। ‘কোয়াড’ জোট, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই দিল্লি ছিল ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতরেও ধারণা ছিল, দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ও শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় ভারতের বিকল্প নেই।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণায় ফাটল ধরতে শুরু করে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং সামরিক সক্ষমতা ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
আঞ্চলিক সংকটে দ্রুত ও কার্যকর ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে ভারতের অনীহা বা অক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দীর্ঘদিন এসব বিষয় উপেক্ষা করা হলেও, ২০২৫ সালে এসে যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে শুরু করে যে শুধু আদর্শিক বা কৌশলগত কারণে ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
এই সময়েই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে নীরবে। প্রথমে আসে সন্ত্রাসবাদ দমনে সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়। ওয়াশিংটনের কাছে এটি ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংকেত—ইসলামাবাদ হয়তো সত্যিই তাদের অবস্থান বদলাতে আগ্রহী। এরপর মার্চ মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকার প্রশংসা করেন। এই মন্তব্য ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারক মহলে বিস্ময় তৈরি করে, কারণ এটি এত দিনের প্রতিষ্ঠিত বয়ানের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল।
পাকিস্তানের জন্য এই মুহূর্তটি ছিল এক ধরনের সুযোগের জানালা। ইসলামাবাদ বুঝে যায়, সামান্য সহযোগিতার বিনিময়েও ওয়াশিংটনের কাছ থেকে বড় কূটনৈতিক লাভ আদায় করা সম্ভব। ধীরে ধীরে সম্পর্কটি লেনদেনভিত্তিক সীমা ছাড়িয়ে গভীর কৌশলগত গুরুত্ব পেতে শুরু করে। যাঁরা একসময় পাকিস্তানকে অবজ্ঞা করতেন, তাঁরাই এখন দেশটিকে দায়িত্বশীল ও নমনীয় অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করতে শুরু করেন।
এই সম্পর্ক পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট আসে মে মাসে, যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র সামরিক সংঘাত ঘটে। কয়েক দিনের এই উত্তেজনায় পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি, শৃঙ্খলা ও কৌশলগত দক্ষতা ট্রাম্পকে স্পষ্টভাবে প্রভাবিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্লেষক যাঁরা পাকিস্তানকে দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন, তাঁরা নতুন করে তাদের মূল্যায়ন করতে বাধ্য হন। ওয়াশিংটনের চোখে পাকিস্তান আবারও একটি কার্যকর আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এই সংঘাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব। যুদ্ধবিরতির জন্য ট্রাম্প যখন এগিয়ে আসেন, তখন ভারত তা প্রত্যাখ্যান করে। বিপরীতে পাকিস্তান প্রকাশ্যে কৃতজ্ঞতা জানায়। ‘যুদ্ধ শুরু নয়, শেষ করাই নেতৃত্ব’—এই বিশ্বাসে আস্থাশীল ট্রাম্পের কাছে ভারতের এই অবস্থান হতাশাজনক বলে মনে হয়। এর ফল হিসেবে দিল্লির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে, আর ইসলামাবাদের কূটনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়।
এই নতুন বাস্তবতায় পাকিস্তান শুধু কূটনৈতিক স্বীকৃতিই পায়নি, পেয়েছে সামরিক ও রাজনৈতিক মর্যাদাও। দেশটির সামরিক কাঠামোয় বড় সংস্কার এনে ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ নামে নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়, যেখানে একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। তাঁর ব্যক্তিত্ব, শৃঙ্খলা ও কৌশলগত চিন্তাভাবনা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ওয়াশিংটনের অন্দরমহলে আসিম মুনিরকে এখন দেখা হচ্ছে এক রহস্যময় কিন্তু নির্ভরযোগ্য শক্তি হিসেবে।
এই সম্পর্কের প্রতীকী চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় যখন আসিম মুনির হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ পান। পাকিস্তানের কোনো সামরিক প্রধানের জন্য এটি ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। ক্যামেরাবন্দী এই মুহূর্ত দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এত দিন যে পাকিস্তানকে সন্দেহ ও সতর্কতার চোখে দেখা হতো, তার জায়গায় তৈরি হয় মুগ্ধতা ও উদ্যাপনের আবহ।
২০২৬ সালের শুরুতে এসে পাকিস্তান এখন ট্রাম্প প্রশাসনের দক্ষিণ এশিয়া ও দূরপ্রাচ্য কৌশলের কেন্দ্রে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পাকিস্তানের গুরুত্ব বহুমাত্রিক। ইরানের সঙ্গে গোপন যোগাযোগের সম্ভাব্য সেতু, মধ্যপ্রাচ্যের সংকট—বিশেষ করে গাজা পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতার একটি চ্যানেল, এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি—সব দিক থেকেই পাকিস্তান এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
এর ফলে ওয়াশিংটনের ‘ভারত প্রথম’ নীতির আপাতত অবসান ঘটেছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। যদিও যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙে যাচ্ছে—এমন ধারণা অতিরঞ্জিত হবে। তবে এটা স্পষ্ট যে দিল্লি আর এককভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ওয়াশিংটনের প্রধান ভরকেন্দ্র নয়। ভবিষ্যতে এই ভারসাম্য কতটা টিকে থাকবে, তা অনেকটাই নির্ভর করবে ভারত ও পাকিস্তান—উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আঞ্চলিক আচরণের ওপর।
২০২৫ সালে পাকিস্তানের এই রূপান্তর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি বড় বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। যে দেশটিকে একসময় ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় ফেলার চেষ্টা চলছিল, সেই পাকিস্তানই এখন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। এই পরিবর্তন কেবল দুই দেশের সম্পর্কের গল্প নয়; এটি প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই—আছে কেবল স্বার্থ, সময় ও সুযোগের হিসাব।
আপনার মতামত জানানঃ