দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্য আজ এমন এক অনিশ্চিত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা পুরো অঞ্চলের কৌশলগত সমীকরণ বদলে দিতে পারে। পাকিস্তান বর্তমানে অদ্ভুত এক থমথমে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—যেমন ভয়ানক ঝড় চলে গেলে কিছু সময়ের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে আসে, কিন্তু সেই নীরবতার আড়ালেও থাকে নতুন অস্থিরতার গন্ধ। দেশটির রাজনীতিতে সেই নীরবতা এখন গভীরভাবে চাপ সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানের ইতিহাসে বহু রাজনৈতিক বিপর্যয় এসেছে, বহু সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে, কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে ক্ষমতার কেন্দ্র অনানুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি সেনাকর্তাদের হাতে চলে গেছে এবং বেসামরিক রাষ্ট্র কাঠামো কেবল আনুষ্ঠানিক মুখোশে টিকে আছে।
ইমরান খান–পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা—এখন আদিয়ালা জেলে বন্দী। তিনি কেবল একজন নেতা নন, বরং এক প্রজন্মের রাগ, হতাশা ও ক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তাঁর পতন পাকিস্তানের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে। দুর্নীতির মামলায় তাঁর সাজা, দলকে ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ এবং পিটিআই নেতাকর্মীদের ওপর ধারাবাহিক দমন-পীড়ন দেশটিতে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে গণতন্ত্রের ন্যূনতম কাঠামোও ভঙ্গুর। তবুও এই সবকিছুর মাঝেও ইমরান খান পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে আছেন। তাঁর জনপ্রিয়তা কমেনি; বরং তিনি এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়েছেন, যেটিকে জনগণের বড় অংশ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করে। শহুরে তরুণ, মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ার যুবকরা এখনো ইমরানকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রতিরোধের নেতা হিসেবে দেখেন। তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতীক হারানো, কর্মীদের গ্রেপ্তার, সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা—এসব দমন-পীড়ন সত্ত্বেও পিটিআই ভেতর থেকে এখনও বেঁচে আছে।
এই জটিল পরিস্থিতির পেছনে যিনি সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকায় আছেন, তিনি পাকিস্তানের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। পাকিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোর স্থপতি বলা যায় তাঁকেই। তিনি শুধু সেনাবাহিনীর প্রধান নন, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও কৌশলগত নীতির মূল নিয়ন্ত্রক। শাহবাজ শরিফ নামমাত্র প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁর রাজনৈতিক শক্তির উৎস জনগণ নয়; বরং সেনাবাহিনীর কৌশলগত প্রয়োজন। দেশের রাজনীতির এই বেসামরিক–সামরিক টানাপোড়েন কোনো নতুন বিষয় নয়, কিন্তু মুনিরের অধীনে এটি আনুষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। তিনি বেসামরিক নেতৃত্বকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন যে বাস্তবে পাকিস্তানের নীতি নির্ধারণ এখন সামরিক সদর দপ্তরের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে।
এই ক্ষমতার বিন্যাস সাময়িকভাবে কার্যকর হলেও ভেতরে-ভেতরে অত্যন্ত ভঙ্গুর। কারণ পাকিস্তানের অর্থনীতি দুর্বলতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে। ঋণসঙ্কট, আইএমএফের কঠোর শর্ত, শিল্পোৎপাদনে স্থবিরতা এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস—সব মিলিয়ে অর্থনীতির ভিত কাঁপছে। আর্থিক ভঙ্গুরতা রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের জটিল আঞ্চলিক সম্পর্ক।
আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক এখন চরম উত্তেজনাপূর্ণ। ইসলামাবাদ অভিযোগ করছে যে তেহরিক-এ-তালেবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) তালেবান আশ্রয় দিচ্ছে, আর সেনাবাহিনী এই পরিস্থিতিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখছে। টিটিপির হামলা বাড়তে থাকায় পাকিস্তান আফগানিস্তানের ভেতরে বিমান হামলা চালিয়েছে, সীমান্ত বন্ধ করেছে এবং লাখো অনথিভুক্ত আফগানকে ফেরত পাঠিয়েছে। এই টানাপোড়েন চলতে থাকলে পাকিস্তানের ভেতরের অস্থিরতা আরও বাড়বে, কারণ টিটিপি বিষয়টি দেশটির প্রতিটি সরকারের জন্য বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে ভারত আফগানিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে। এটি পাকিস্তানের জন্য একধরনের কৌশলগত অস্বস্তি তৈরি করেছে। ভারতের জন্য পরিস্থিতিটি ভিন্ন অর্থ বহন করে। কারণ ভারত মাত্র কিছুদিন আগে কাশ্মীরের পেহেলগামে এক ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলার মুখে পড়েছে এবং পরে পাকিস্তানের ভেতরে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এর ফলে ভারত–পাকিস্তান সম্পর্ক এমন উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে সামান্য উসকানিও বড় সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। আজ সীমান্তে সীমিত সংঘর্ষ, ড্রোন যুদ্ধ, ক্ষেপণাস্ত্র নজরদারি—সবই এক নতুন নিয়মে পরিণত হয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি অনিশ্চয়তার বোঝা তৈরি করছে।
চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর যদিও এখনো পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দু, তবে চীনের আস্থা এখন আগের মতো নেই। প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি, নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চীনকে আরও সতর্ক করে তুলেছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র আবার পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে মূলত সন্ত্রাসবাদবিরোধী কারণ থেকে। ওয়াশিংটনে শাহবাজ এবং মুনিরের যৌথ সফর দেখিয়েছে যে ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে গুরুত্ব দিচ্ছে বটে, কিন্তু সম্পর্কটি সম্পূর্ণ লেনদেনভিত্তিক। আর এই সম্পর্কের ভারসাম্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সৌদি আরব। দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব পাকিস্তানের ত্রাণকর্তা হিসেবে কাজ করেছে—চাই অর্থনৈতিক সহায়তা, চাই কৌশলগত সুরক্ষা। কিন্তু এখন সৌদি আরবের ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে, যা পাকিস্তানের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করছে।
এই জটিল আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ভারত–পাকিস্তান সম্পর্ককে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে। দুই দেশের মধ্যে একসময় যে দুইটি মৌলিক চুক্তি—সিন্ধু পানিচুক্তি এবং শিমলা চুক্তি—উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করত, সেগুলো আজ প্রায় অকার্যকর। এর ফলে এখন আর কোনো স্থায়ী কাঠামো নেই যা উত্তেজনা বাড়লে সেটিকে থামিয়ে রাখতে পারে। আর যখন একটি দেশ ভেতর থেকে বিপর্যস্ত হয়, তার নীতিনির্ধারণ অনেক বেশি তাৎক্ষণিক, আবেগনির্ভর এবং অনির্দেশ্য হয়ে পড়ে। পাকিস্তান এখন ঠিক এমন একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে।
ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই অনিশ্চয়তার রাজনীতি। একটি দুর্বল, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এবং রাজনৈতিকভাবে চাপে থাকা পাকিস্তান যেকোনো সময় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে যা বেসামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই সিদ্ধান্তের প্রভাব সরাসরি ভারতের সীমান্তে, নিরাপত্তা কাঠামোতে, এবং বৃহত্তর কৌশলগত লক্ষ্যগুলোতে পড়তে পারে। দিল্লির জন্য তাই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো পাকিস্তানের ভেতরের অস্থিরতা যেন ভারতের বড় কূটনৈতিক প্রয়াস—ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি, উপসাগরীয় প্রভাব, মধ্য এশিয়া-আফগানিস্তান কৌশল—এসবকে ব্যাহত না করে।
ভারতকে এখন বুঝতে হবে যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক শিগগিরই কোনো বড় চুক্তি, শান্তি-সমঝোতা বা নাটকীয় কূটনৈতিক সাফল্যে বদলে যাবে না। বরং সম্পর্ককে ধরে রাখতে হলে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং কৌশলগত ধৈর্য সবচেয়ে প্রয়োজন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতরে যে পরিবর্তন চলছে, সেটিকে বুঝে ভারতকে নিজের কৌশল সাজাতে হবে। কারণ একটি দুর্বল রাষ্ট্র যতটা বিপজ্জনক, একটি অনির্দেশ্য রাষ্ট্র তার চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র হলো—পাকিস্তানের ভেতরের রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এবং আঞ্চলিক চাপ মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এক নতুন অস্থির যুগ শুরু হয়েছে। এর প্রভাব শুধু পাকিস্তান বা ভারত নয়, পুরো অঞ্চলকে স্পর্শ করবে আগামী বছরগুলোতে।
আপনার মতামত জানানঃ