ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক মহড়া — একে অপরের পাশেই, একই সময়ে — দেখে অনেকেই প্রশ্ন করছেন: বিধ্বংসী সংঘাত হবে কি না, নাকি দুই দেশের সামরিক কূটকৌশলই চলছে? গত কয়েক দিনে উপকূল ও সীমান্তভিত্তিক বড়—বড় অনুশীলন দেখে এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। ভারতের ‘ত্রিশূল’ নামক তিন বাহিনী সম্মিলিত মহড়া গুজরাট—রাজস্থান সীমান্ত ও আরব সাগরের উপকূলে শুরু হয়েছে; একই সময়ে পাকিস্তানও উত্তর আরব সাগরে নৌ মহড়া চালু করেছে — সময়গত ও ভৌগোলিক মিল যে উদ্বেগে বাড়িয়েছে, সেটা অস্বীকার করা যায় না।
এই দুই মহড়া একেবারে নতুন নয়; প্রতিবেশী দুই সামরিক শক্তিই নিয়মিতভাবে নিজেদের সক্ষমতা পরীক্ষা করে থাকে। কিন্তু চলতি বার যে এক সঙ্গে — এবং এমন একটা সংবেদনশীল এলাকায়, যেখানে স্যার ক্রিকের মতো বিতর্কিত অঞ্চল পড়ে — ওই সমসাময়িকতা বিশেষ অর্থ বহন করে। স্যার ক্রিক, ইন্দাস নদের ডেল্টায় অবস্থিত একটি জ্যৈষ্ঠ জলাভূমি, যার উপর দুই দেশের দীর্ঘকালীন দাবি রয়েছে; এর কৌশলগত গুরুত্ব জলসীমা, মৎস্য, পাশাপাশি আইওসি (Exclusive Economic Zone) নির্ধারণেও পড়ে। ইতিহাসে এই খাঁড়িটির সীমানা নির্ধারণ নিয়ে বহু দ্বন্দ্ব হয়েছে এবং তা এখনো পুরোপুরি মীমাংসিত নয় — ফলে যে কোনো সামরিক উদ্বেগ স্বভাৱিকভাবেই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ভাঙন বাড়াতে পারে।
ভারতের পক্ষ মনে করছে, ‘ত্রিশূল’ মহড়ার মাধ্যমে তিন বাহিনী—সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী—একত্রে অপারেশনাল সামর্থ্য উন্নত করা হচ্ছে; আধুনিক অস্ত্র, ইন্টিগ্রেটেড নেটওয়ার্ক, ড্রোন ও কাউন্টার-ড্রোন ব্যবস্থা, এবং দীর্ঘ—দূরত্বের বিমান ও নৌ সক্ষমতার বিভিন্ন দৃশ্যপট প্রদর্শনেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর তর্ক ও সাম্প্রতিক কড়া বিবৃতি মিলিয়ে 보면, এটা কেবল রুটিন অনুশীলন না—কথায় আছে—’অপারেশন সিন্দুর’-এর পরে সবচেয়ে বড় ধরনের মহড়া হিসেবে এটিকে দেখা হচ্ছে। তবে এখানেই জটিলতা: রুটিন অনুশীলন বলে দাবি করলেও এর আকার, বিজ্ঞপ্তি (নোটাম) ও যে অংশ(region) নির্বাচিত হয়েছে, তা রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে পড়া সহজ।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াও কূটপদ্ধতিগত—একেবারে ধাক্কা দেওয়ার ইচ্ছা নয়, বরং সমন্বিত প্রতিরক্ষা প্রদর্শনের মাধ্যমে সতর্কীকরণ। পাকিস্তানি নৌবাহিনী তাদের মহড়ার জন্য নেভাল ন্যাভিগেশন ওয়্যার্নিং (নেভাল ন্যাভিগেশন এলার্ট) জারি করেছে এবং লাইভ-ফায়ারিং অনুশীলনেরও ঘোষণা এসেছে, যা সমুদ্রের ওপর বড় একটি এলাকা কভার করবে। এটাও বলা হয়েছে যে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী নৌ মহড়ার জন্য পত্রিকাভাবে সতর্কতা জারি করা হয়েছে — কিন্ত একই জায়গায় যে দুই বড় মহড়া একসঙ্গে চলছে, তা বিভিন্ন রণনীতিবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকের নজর কাড়ে।
প্রশ্ন — এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি দুর্ঘটনায় বদলে যেতে পারে? ইতিহাসে সীমান্তীয় দুর্ঘটনা বা ‘সলমিং’ যে কখনো কখনো বড় সংঘাতে ঢুকিয়ে দিয়েছে তা নতুন খবর নয়; কিন্তু সাম্প্রতিক মহড়াগুলোর কৌশল বলে দেয়, দুই পক্ষ ক্ষেপণাস্ত্র, নৌ ও বিমান জাহাজের ব্যাপক ব্যবহার করলেও তারা সাধারণত পেশাগত নিয়মে কাজ করে থাকে: নোটাম, নেভাল ওয়র্নিং, সমন্বয় না থাকলেও পর্যবেক্ষণ ও রিডিও-নিয়মে তদারকি করা হয়। ফলে প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন—যদি অনুশীলনগুলো আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলে এবং উদ্বেগজনক কূটনৈতিক বক্তব্যকে অর্পিত সীমায় ধরে রাখা হয়, তাহলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কিছুটা কম। অন্যদিকে, উভয় দেশের নেতাদের গত কয়েক মাসের বক্তব্য, সীমান্তে সামরিক গতিবেগ এবং উভয়পক্ষেই জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সুর শক্ত হওয়ায়—ঝুঁকি শূন্য নয়।
এই মহড়াগুলোর নীচে কৌশলগত উদ্দেশ্যও আছে। প্রথমত, প্রতিটি রাষ্ট্রই নিজেদের ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক অডিয়েন্সকে শক্তি প্রদর্শন করে। ভারতের জন্য ত্রিশূল এমন এক মঞ্চ যেখানে সাব-স্পেস, সাইবার ও ইলেকট্রোম্যাগনেটিক অপারেশন পর্যন্ত প্রদর্শন করা হচ্ছে—এটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দর্শককে দেখে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ও প্রবীণ ন্যারেটিভ উপস্থাপন করার উপায়। পাকিস্তানের পক্ষে, একই জায়গায় নৌ মহড়া দিয়ে তারা দেখাতে চায় যে তাদের সামুদ্রিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে নেই এবং তারা নিজেই প্রতিরোধ ও আভিযানিক সক্ষমতা ধরে রেখেছে। দুপক্ষই সামরিক আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এরকম মহড়াকে কাজে লাগায়; কিন্তু এভাবে সমান্তরাল মহড়া হলে প্রতিপক্ষেরই নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে—এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক প্রতিরক্ষা সচেতনতা (security dilemma) সৃষ্টি হয়।
একই সঙ্গে, স্যার ক্রিক নামের ভূখণ্ডগত সীমাহানি থাকায় এখানে সামুদ্রিক সীমা, ইইজেড (EEZ) সংক্রান্ত দক্ষতা ও মৎস্য অধিকার—সবকয়টি অনুশীলনকে রাজনৈতিক বাক্তিগততার সাথে মেলায়। এই অঞ্চলে নিয়মিত সমুদ্র-পুলিশ, কস্টগার্ড ও রাইফেল মোতায়েন থাকে; মাইক্রো—প্রতিহিংসার ক্ষেত্রে ছোট—উচ্চ-তীব্রতা সংঘাতের সম্ভাব্যতা থেকেই যায়, বিশেষত যখন তেল—গ্যাস, মৎস্য বা সমুদ্রপথের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ জড়িত। সুতরাং, সামরিক মহড়ার পটভূমিতে কূটনৈতিক চ্যানেলে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই ধরনের মহড়ার রাজনৈতিক বার্তা দুর্যোগজনক না করে কাস্টমাইজড ‘ডিটারেন্ট’ (deterrent) হিসেবে পাঠানো হচ্ছে। অর্থাৎ—দলবল দেখানো, স্যামসাম (show of force) করা, কিন্তু সরাসরি আক্রমণের ইঙ্গিত না দেয়া—এটাই মূল উদ্দেশ্য। সেটাই সাধারণ কূটনীতি; বড়—বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোই কৌচিকভাবে প্রতিপক্ষকে সতর্ক করে নিজেদের আগ্রাসন দূর রাখে। তবে বাস্তব চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—এই সতর্কীকরণ কখনো কখনো কড়া বাক্যবাণের সঙ্গে মিলিত হলে পরস্পরের ভুল ব্যখ্যায় বড় দখল—প্রতিহিংসা ছড়াতে পারে। এখানে রাজনীতিবিদদের, কূটনীতিকদের ও সামরিক প্রধানদের ভূমিকা বড়: তারা যদি শীতল—মস্তকতার সাথে পরিস্থিতি পরিচালনা করে, দুর্ঘটনাকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারবেন।
চূড়ান্তভাবে বলা যায়—এইসময়ের মহড়া দুপক্ষেই একটি মিশ্র বার্তা পাঠাচ্ছে: শক্তি প্রদর্শন করাও হচ্ছে, একই সঙ্গে কোনও অসাবধানতায় উত্তেজনা বাড়লে তা মোকাবিলা করার সক্ষমতাও প্রদর্শিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এটাকে ‘ক্যুরেটিভ ডিটারেন্স’ বললেও, নীচেই থাকা বাস্তব কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো—দুই দেশের দূতাবাস, সীমান্ত—কমান্ডার স্তরের যোগাযোগ ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যেমে সংঘটিত ভুল বোঝাবুঝি ঠেকানোই সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। সংবাদপত্র ও বিশ্লেষণে উঠে এসেছে—নোটাম, নেভাল ওয়র্নিং ও বিজাতীয় কৌশলের মধ্যে প্রফেশনালিজম বজায় রেখে খেলাই নিরাপত্তা বাড়ায়; কিন্তু যদি রাজনীতিতে অশান্তি বিরাজ করে, তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত জটিল ঘটতে পারে।
পারস্পরিক সতর্কতা—এবং কূটনৈতিক বার্তা—দুই দেশের ভবিষ্যৎ আচরণ নির্ধারণ করবে। নিয়মিততা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে যদি মহড়াগুলো চালানো যায়; অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বিধি মেনে নোটাম ও সমুদ্র—উপকূলীয় সতর্কতা দেওয়া হয়, এবং উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ বজায় থাকে—তবে এই ধরনের মহড়া প্রায়ই কেবল প্রতিরক্ষা পরীক্ষাই থেকে যায়। অন্যদিকে, রাজনৈতিক রটনা, উন্মাদ সশস্ত্র চিন্তা বা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটে কোনো পক্ষ যদি কড়া কণ্ঠ গ্রহণ করে, পরিস্থিতি দ্রুত তিক্ত হতে পারে। ফলে সমাধানও কেবল সামরিক শক্তি নয়—কূটনৈতিক সংলাপ ও স্থানীয় সমঝোতা, সীমান্ত কমিউনিকেশন লাইন পুনরুজ্জীবিত করা।
শেষ কথা—ত্রিশূল আর পাকিস্তানের নৌ মহড়া একই সময়ে হওয়ায় বিবেচ্য যে এটি শুধু ‘মিলিটারিস্ট শো’ নয়; এটি এক ধরনের কৌশলগত বার্তা, প্রতিপক্ষকে সতর্ক করার উপায়, এবং অভ্যন্তরীণ দর্শককে শান্ত করার কৌশলও। কিন্তু সবচেয়ে বড় উদ্বেগ থেকে যায় — দুর্ঘটনা, ভুল ক্যালকুলেশন বা আলোচিত কৌশলিক বর্ধনের ফলে কোনো অনাবশ্যক সংঘাতের সূচনা হওয়া। এ কারণেই দুই দেশের কূটনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের ওপর এখন বিশাল দায়িত্ব: তারা যদি ঠাণ্ডা মাথায়, নিয়ম মেনে, খোলামেলা যোগাযোগ বজায় রাখে—তবে মহড়াগুলো নিরাপত্তা বাড়াবে; নতুবা — এগুলোই ফিডার হিসেবে বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
(এই লেখায় তথ্য-উত্স হিসেবে সাম্প্রতিক সংবাদ ও বিশ্লেষণ ব্যবহার করা হয়েছে)।
আপনার মতামত জানানঃ