২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে শুরু হওয়া ছাত্র-ছাত্রীর নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ, যা দ্রুত ছোট আন্দোলন থেকে পরিণত হয় একটি বৃহৎ গনতান্ত্রিক সাবলীল চ্যালেঞ্জে, সেই আন্দোলন দমাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও গোপন আয়োজনগুলোর মাধ্যমে উদ্ধার হয়েছে এক ভয়ানক রূপ। এই সময়ের ঘটনাবলীর তদন্ত শেষে দেশটির International Crimes Tribunal‑1 (ICT-1) ১৭ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে রায় ঘোষণা করেছে — সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার রায় দেওয়া হয়েছে। রায় হাইলাইট করেছে, তিনি শুধু সহিংস প্লান ও দমননীতির দাবি পাওয়া রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের অনুমোদকই নন, বরং তার নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাপনাই ছিল ওই মৃত্যুমিছিলের মূল ধাঁচ।
বিচারপ্রক্রিয়া, প্রেক্ষাপট, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক আকস্মিকতা — এই চারখানা দিকে আলোকপাত করেই এই ফিচারে অনুসন্ধান করা হয়েছে।
প্রেক্ষাপট ও আন্দোলনের সূত্রপাত
২০২৪ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার দাবি নিয়ে সোনার বাংলা শহরে রাস্তায় নামেন। তারা দাবি জানায়, কোটা দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স, যোগ্যতা ও অন্য বিবেচ্য বিষয় যথাযথ নয়। বিক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ-শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। পরিস্থিতি ঘনিয়ে ওঠে যখন সরকার ও প্রশাসন সেই আন্দোলনকে শুধু শিক্ষার্থীদের দাবি নয়, বরং “দেশবিরোধী” শক্তির উস্কানিতে ব্যাহত হতে পারে এমন ভাবনা থেকে দমন শুরু করে।
এই চাপে উত্তরাধিকারী হিসেবে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নিরাপত্তা বাহিনী, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (RAB) সহ সামরিক-অধিকৃত ইউনিট তৎপর হয়। তদন্ত অনুসারে, এই বাহিনী শুধুই ভাঙচুর দমন করেনি, বরং হত্যাকাণ্ড, গুলি, হেলিকপ্টার ও ড্রোনের ব্যবহার এমনকি আহতদের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে বরখাস্ত করা—এই সব কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও Office of the United Nations High Commissioner for Human Rights (OHCHR) অনুসারে, এই সময় “একাধিক হত্যাকাণ্ড এবং গুরুতর নির্যাতন” সংঘটিত হয়েছিল যা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনার পর্যায়ে উঠেছে।
এই পটভূমিতে, ২০২৫ সালের জুনে ICT-1 ওই ঘটনায় মামলা চালুর ঘোষণা দেয়। অভিযোগ আনা হয় শেখ হাসিনা ও তার সড়ক পর্যায়ের দুই–তিনজন সহযোগীর বিরুদ্ধে—ক্ষমতার অপব্যবহার, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, রাষ্ট্রীয় যন্ত্রনায় অব্যাহত নির্যাতন প্রভৃতি।
বিচারপ্রক্রিয়া ও রায়
ICT-1-এর বিচারপতি দল, নেতৃত্বে মোঃ গোলাম মর্তূজা মজুমদার ও অন্যান্য দুই বিচারক (মোঃ শফিউল আলম মাহমুদ ও মোঃ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী) ১৭ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে রায় ঘোষণা করে।
এই রায়ে বলা হয়, “অভিযোগভুক্ত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় বাহিনী-বাহন বাহিনীকে দমন অভিযানে ব্যবহার করা হয়, ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে হত্যা ও নির্যাতনের পরিকল্পনা ছিল।”
প্রসিকিউটর আরোপ করেন: যদি প্রতিটি হত্যাকাণ্ড আলাদা হয়ে বিচার হত, তাহলে প্রত্যেকের জন্য মৃত্যুদণ্ড হওয়া যেত—তার অর্থ হলো “১,৪০০’রও বেশি মৃত্যুদণ্ড”।
এর আগে, ২০২৫ সালের জুলাইয়েও ঐ ট্রাইব্যুনাল একটি ভিন্ন মামলায় শেখ হাসিনাকে আদালতের অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে— যদিও উনি ভারতে পালিয়ে রয়েছেন।
এই বিচারপ্রক্রিয়া অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও নজর কাড়ে—প্রথমবারের মতো কোনো বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কারাগারে না গিয়ে “অনুপস্থিতিতে” মৃত্যুপর্যায়ের রায় দেওয়া হলো।
আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
এই রায়ের ঘোষণা পরেই ঢাকায় উদ্বেগ বাড়ে। রায় ঘোষণার আগে থেকেই রাজধানীতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর করা হয়েছিল—পুলিশ, সেনা ও র্যাব মোতায়েন ছিল; এমনকি “শুট-অন-সাইট” নির্দেশিকাও দেওয়া হয়েছিল যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যদিও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা কামনায় সমর্থন রয়েছে, তবে একাধিক পর্যবেক্ষক বলছেন—ভাষাগত, সাংবিধানিক এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ট্রাইব্যুনাল-প্রক্রিয়ায় সংশয় রয়েছে।
দেশীয়ভাবে, আওয়ামী লীগ এবং তাদের অ্যালায়েডরা এই বিচারকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ বলেছে। তারা দাবি করেছে, এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং নির্বাচন ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার উপক্রম।
উভয় দৃষ্টিকোণেই এই রায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক মানচিত্র ও বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ
এই রায়ের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা এক নতুন মোড় নিচ্ছে। প্রথমত, রাজনৈতিক সংস্কার ও ক্ষমতার অপব্যবস্থার দৃষ্টান্ত হিসেবে এই রায় দেখছে অনেকেই। দ্বিতীয়ত, যদিও রায় দেওয়া হয়েছে, বাস্তব জটিলতা রয়েছে — আইনগতভাবে রায় কার্যকর হবার আগে শরণার্থী অবস্থায় থাকা অভিযুক্তের গ্রেফতার বা আত্মসমর্পণ প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, ভবিষ্যৎ নির্বাচন‐প্রক্রিয়া, দলীয় রাজনীতি এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের স্বাধীনতা পরিস্থিতি এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ধাবিত হতে পারে। বর্তমান বিরোধী দল বলছে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। চতুর্থত, বিচারপ্রক্রিয়া ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজর এখন কেবল রায়ের ফলাফল নয়—ভবিষ্যতে বিচারপ্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ, স্থিতিশীল ও ন্যায়সংগত হবে, তা নিয়েও।
সব মিলিয়ে, এই রায় শুধু এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেওয়া ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গে এক গণতান্ত্রিক পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার মতামত
আমার মতে, এই রায় একটি দ্বিমুখী মর্মরেখা — একদিকে এটি দেখাচ্ছে যে কোনও রাষ্ট্রে উচ্চ মাত্রার দায়বদ্ধতা বসাতে সাহস রয়েছে, অপরদিকে এটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে বিচার শুধুই রায় নয়—বিচার হলো স্বচ্ছতা, স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সাথে প্রক্রিয়াগত যুক্ত হওয়া।
বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে—এই রায়কে ভিত্তি করে সামাজিক পুনর্মিলন ও রাজনৈতিক সংলাপ তৈরি করা, যাতে বিচার একমাত্র প্রতিশোধের হাতিয়ার না হয়ে সত্যিকার অর্থে পরিবর্তনের পথ হয়ে ওঠে। যদি বিচারব্যবস্থায় সন্দেহ ও বিশ্বাসঘাতকতার ভাব থাবা ধরে, তবে রায় দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক বিভাজনের অধিক কারণ হয়ে উঠতে পারে।
সুতরাং, শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় শুধুই একটি বিচারপ্রয়াস নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, সামাজিক মনোবল ও আন্তর্জাতিক অবস্থান সবকিছুর ওপর এখন এক কঠিন চ্যালেঞ্জ ফেলে দিয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ