বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুলনায় আন্দোলনরত ৮ দলের আয়োজিত বিভাগীয় সমাবেশটি ছিল সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক জমায়েত, যেখানে নেতাদের ভাষণে উঠে এসেছে দেশের বর্তমান বাস্তবতা, ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশনা এবং জনগণের প্রত্যাশা–নিরাশার বিশদ চিত্র। সমাবেশের মূল বক্তা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান তাঁর বক্তব্যে দেশের চলমান পরিস্থিতিকে এক গভীর সংকটের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর ভাষণে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি, শাসনব্যবস্থার অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনের সামনে থাকা সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো। তিনি বলেন, দেশের ক্ষমতার ভারসাম্য এমনভাবে নষ্ট হয়ে গেছে যে, ক্ষমতায় না থেকেও একটি গোষ্ঠী ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছে, প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে এবং জনগণের ওপর চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, অরাজকতার মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করছে। তাঁর মতে, ৫ আগস্টের ঘটনার পরপরই একটি গোষ্ঠী জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্টা চালাচ্ছে, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।
ডা. শফিকুর রহমান দেশের ১৮ কোটি মানুষের বিজয়ের আহ্বান জানিয়ে বলেন, তিনি ৮ দলের নয়—সকল মানুষের মুক্তি চান। তাঁর ভাষণে বারবার উঠে আসে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি এবং কায়েমি স্বার্থবাদী চক্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের ঘোষণা। তিনি দাবি করেন, বর্তমানে দেশে এমন এক অদৃশ্য প্রশাসনিক ‘ক্যু’য়ের প্রচেষ্টা চলছে, যার মাধ্যমে একটি অংশ নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চাইছে। এই পরিস্থিতি তিনি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার জন্য ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার এমন পরিস্থিতিতে তিনি জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সূর্য প্রায় ডুবে গেছে—সময়ের সুযোগ আর বেশি নেই। তাঁর মতে, এবার জনগণ যদি নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অদম্য হয়, তাহলে কোনো ষড়যন্ত্র তাদের পথ রোধ করতে পারবে না।
তাঁর ভাষণে বিশেষভাবে উঠে আসে ভোটাধিকার বঞ্চিত মানুষের বেদনার কথা। তিনি বলেন, বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে যারা ভোট দিতে পারেননি, এবারের নির্বাচনে যদি তাদের ভোটাধিকার নিয়ে কেউ ছিনিমিনি করতে চায়, তাহলে তা বরদাশত করা হবে না। তিনি যুবসমাজকে উদ্দেশ করে বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতে তুলে দেওয়ার সময় এসেছে। চাকরি চাইতে নয়, চাকরি দিতে হবে—এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি এক ধরনের আত্মনির্ভরশীল, দক্ষ, নৈতিকতাবান প্রজন্ম গড়ে ওঠার আশা ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতার পর অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও জনগণের লালিত স্বপ্নের অনেকটাই অপূর্ণ থেকে গেছে। দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও তা প্রকৃত উন্নয়ন নয়—ন্যায়বিচার, সাম্য ও সুশাসন ছাড়া কোনো উন্নয়ন টেকসই হয় না।
সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর পীরসাহেব চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মো. রেজাউল করীম। তিনি তাঁর বক্তব্যে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অভূতপূর্ব এবং অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেন। অনেকে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে, তাঁরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নন—এই বক্তব্য তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর দাবি, তাঁরা নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত; বরং বিপরীত পক্ষই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগেই দেখে ফেলেছে যে তাদের পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। এ কারণেই ষড়যন্ত্র, কেন্দ্র দখল, সন্ত্রাসী তৎপরতা—এসব কৌশল নিয়ে তারা নেমে পড়েছে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, গুণ্ডামি করে আর ক্ষমতার চেয়ারে বসা যাবে না—জনগণ সেই সুযোগ এবার আর দিতে রাজি নয়।
সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর আল্লামা মামুনুল হক। তিনি জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে নতুন বাস্তবতার সূচনা হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে জাতি দুটি অংশে বিভক্ত—এক পক্ষ ১৯৭২-এর বাকশালপন্থি শক্তি, অন্য পক্ষ ২০২৪ সালের বিপ্লবপন্থি গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি। তাঁর মতে, জুলাই সনদের মধ্য দিয়ে আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি তৈরির যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তাকে দৃঢ় ভিত্তি দিতে গণভোট আয়োজন করা জরুরি। তিনি এক ধরনের জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন, যাতে অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি দূর করে রাষ্ট্র সুস্পষ্ট নীতিনির্দেশনা পায়। একই সঙ্গে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য দোয়া চান, যা রাজনৈতিক ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও মানবিক অবস্থানের পরিচায়ক।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুফতি মুসা বিন ইজহার, খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদেক হক্কানী, জাগপার সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান, বিডিপি চেয়ারম্যান এডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চাঁনসহ বিভিন্ন ইসলামী দল ও জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা। তাদের বক্তব্যেও প্রতিফলিত হয় দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার আকাঙ্ক্ষা, সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি এবং জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার সংকল্প। তাদের মতে, একটি শক্তিশালী গণভিত্তির উত্থান ঘটছে, যা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অংকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সমাবেশের বক্তব্যগুলো থেকে স্পষ্ট যে দেশ বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে রাজনৈতিক পুনর্গঠন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা—সবকিছুই জরুরি হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দল তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করলেও এক বিষয়ে তারা সবাই একমত—দেশে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে জনগণকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। মানুষ এখন পরিবর্তন চায়, ন্যায়বিচার চায়, ভোটাধিকার চায়, দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা চায়। দীর্ঘদিনের অস্থিরতা, অর্থনৈতিক চাপ, দুর্নীতির বিস্তার এবং শাসনব্যবস্থার সংকট—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ এখন ক্লান্ত, নিরাশ এবং আগ্রহী নতুন এক রাজনৈতিক পথে।
এই প্রেক্ষাপটে সমাবেশের নেতারা যে বার্তা দিয়েছেন তা শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য নয়—এটি জনগণের গভীর উদ্বেগ, আকাঙ্ক্ষা এবং পরিবর্তনের আহ্বানের প্রতিধ্বনি। তাদের কথায় উঠে এসেছে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন—একটি দেশ যেখানে স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে, মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার থাকবে, এবং কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর প্রভাব কমে যাবে। সমাবেশের মাধ্যমে যে সুর ভেসে এসেছে তা হলো—এবারের নির্বাচন শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন নয় বরং এক গভীর রাজনৈতিক রূপান্তরের সম্ভাবনা বহন করছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজে এখন প্রশ্ন—এই পরিবর্তন কীভাবে বাস্তবে রূপ নেবে? জনগণের ইচ্ছা কতটুকু প্রতিফলিত হবে? রাজনৈতিক দলগুলো কি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক আচরণ প্রদর্শন করবে? প্রশাসন কি নিরপেক্ষতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে? এসব প্রশ্নের উত্তরই ভবিষ্যতের পথচলা নির্ধারণ করবে। আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতি যতই জটিল হোক, জনগণের সক্রিয় ভূমিকা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ় ও ইতিবাচক অবস্থান—এই দুয়ের সমন্বয়েই গড়ে উঠতে পারে একটি ন্যায়ভিত্তিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
খুলনার এই সমাবেশ তাই শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক আয়োজন নয়; এটি ছিল একটি যুগসংকটের সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি—কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ, কোথায় যাবে সামনে, আর সেই পথচলায় জনগণের ভূমিকা কী হওয়া উচিত—তার স্পষ্ট প্রতিফলন।
আপনার মতামত জানানঃ