
ভারতে ধর্মীয় উত্তেজনা, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব নিয়ে যে আলোচনা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে, জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের সভাপতি মাহমুদ মাদানির সাম্প্রতিক মন্তব্য সেই বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের মুসলমানদের নাগরিক অধিকার সংকুচিত হওয়ার অভিযোগ উঠছে নানা মহল থেকে, কিন্তু মাদানির বক্তব্যে বিষয়টি নতুন করে রাজনৈতিক অগ্নিশিখায় পরিণত হয়েছে। তিনি সরাসরি দাবি করেছেন—ভারতের সংবিধান সংখ্যালঘুদের যে অধিকার নিশ্চিত করেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদালতের কিছু রায় সেই অধিকারকে বাস্তবে দুর্বল করে দিয়েছে। তার অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাবরি মসজিদের রায়, তিন তালাক-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত এবং সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত আইন সম্পর্কিত আলোচনাগুলো, যেগুলো দেশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিবেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।মাদানির বক্তব্যের অন্যতম গুরুতর অংশ হলো—বিচার বিভাগের ওপর সরকারের মৃদু বা প্রত্যক্ষ চাপ থাকার অভিযোগ। বিচারব্যবস্থা যে রাষ্ট্রের শেষ ভরসাস্থল, সেখানে যদি ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ ঢুকে পড়ে, তাহলে সংবিধানের ভারসাম্য নষ্ট হয়—এ কথাই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন। তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সংবিধান যাদের রক্ষা করার কথা, সেই সংখ্যালঘুরাই আজ নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করছেন। নানা মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় সরকারপন্থী ব্যাখ্যার প্রাধান্য দেখা গেলে সাধারণ মানুষের আস্থা ক্ষুণ্ণ হয়—এটা তার বক্তব্যে স্পষ্ট।
জিহাদ প্রসঙ্গে তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গি সামনে এনেছেন, তা ভারতের সাম্প্রতিক পথপরিক্রমায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ‘লাভ জিহাদ’ বা ‘ল্যান্ড জিহাদ’-এর মতো রাজনৈতিক শব্দবন্ধকে তিনি সরাসরি ‘ধারণার বিকৃতি’ বলে অভিহিত করেছেন। তার যুক্তি—ইসলামী পরিভাষায় জিহাদ মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, মানুষের মঙ্গল কামনায় প্রচেষ্টা। অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই শব্দকে ভয় ও বিভ্রান্তির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যার ফলে মুসলমানদের উপর অন্যায্য সন্দেহ আরোপিত হচ্ছে। মাদানি স্পষ্ট করে বলেছেন—জিহাদ হিংসা নয়; বরং নৈতিক সংগ্রাম। তবে তিনি এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো কোনো ধরনের সহিংসতাকে সমর্থন করে না এবং দেশের মুসলমানেরা সংবিধানের প্রতি অনুগত।
১৯৯১ সালের উপাসনালয় আইন থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা নিয়ে মামলার যে ধারাবাহিকতা চলছে, সে বিষয়েও শক্ত ভাষায় তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তার বক্তব্য—যে আদালত সংবিধান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তাকে ‘সর্বোচ্চ’ বলা যায় না। এই মন্তব্য শুধু আইনি বিতর্ক নয়; বরং দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন। তার মন্তব্যে বোঝা যায়—সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ শুধু আইনি নিরাপত্তা নয়; এর সাথে জড়িয়ে আছে ভবিষ্যৎ নাগরিক অধিকার ও সামাজিক মর্যাদার বিষয়টিও।
মাদানির বক্তব্য প্রকাশের পর বিজেপির পাল্টা প্রতিক্রিয়া এসেছে প্রত্যাশিতভাবে তীব্র সুরে। তারা অভিযোগ করেছে—মাদানি ইচ্ছাকৃতভাবে দেশবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং সরকারের উন্নয়নমুখী উদ্যোগকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছেন। বিজেপির নেতারা মনে করেন, আদালত ও সরকারের সিদ্ধান্তগুলো ‘জাতীয় স্বার্থ’ ও ‘সামাজিক সংস্কারের’ সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ; ফলে এ ধরনের অভিযোগ বাস্তবতাবর্জিত। তাদের দাবি—ভারতের সংবিধান সবার জন্য সমান, এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার আগের মতোই সুরক্ষিত।
তবে বুদ্ধিজীবী মহলের অনেকেই মনে করছেন—ভারতে রাজনৈতিক ভাষা যত বেশি তীব্র হচ্ছে, তত বেশি ধর্মীয় পরিচয় ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসছে। বাবরি মসজিদ থেকে গুজরাট দাঙ্গা—এর প্রতিটি ঘটনায় বিচার বিভাগের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন কিছুটা হলেও রয়ে গেছে। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, এনআরসি, হিজাব বিতর্ক কিংবা ধর্মান্তর বিরোধী আইনের মতো নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ মুসলমানদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। ফলে মাদানির মন্তব্য শুধু একটি সংগঠনের অবস্থান নয়—এটি ভারতের বৃহত্তর ধর্মীয় বাস্তবতার একটি প্রতিফলন। তিনি যখন বলেন যে সংখ্যালঘুরা ন্যায্য অধিকার পাচ্ছেন না, তখন এ বক্তব্যটি লাখো মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল খুঁজে পায়।
ভারতীয় সমাজ এখন প্রকৃত অর্থেই একটি সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সংখ্যালঘুদের অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় শব্দের রাজনৈতিক অপপ্রয়োগ—এ তিনটি বিষয়ই ভারতের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এ অবস্থায় মাদানির বক্তব্য মুহূর্তে মিলিয়ে যাওয়ার মতো কোনো মন্তব্য নয়; বরং এটি ভারতের সামাজিক বাস্তবতার গভীরে থাকা অসন্তোষ, অসহায়ত্ব এবং অসমতার কথাই নতুন করে তুলে ধরছে। বিজেপির পাল্টা প্রতিক্রিয়া যেমন রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, তেমনি মুসলিম সংগঠনগুলোর তীব্র ভাষাও তাদের নিরাপত্তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ।
এই দুই স্রোতের সংঘাতে ভারতের সামগ্রিক রাজনীতিতে উত্তেজনা আরও বাড়ছে। সংবিধান, ধর্মীয় পরিচয় এবং নাগরিক অধিকার—এই তিনটি স্তম্ভই বারবার আলোচনার কেন্দ্রে আসছে। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ভবিষ্যতে কোন পথে যাবে, তার গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত এখনই ফুটে উঠছে। পরিস্থিতি পরোক্ষভাবে বলে দিচ্ছে যে ভারতের সমাজ এক নতুন পর্বে প্রবেশ করছে যেখানে অধিকারের প্রশ্ন, পরিচয়ের প্রশ্ন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা—সবই নতুন করে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
আপনার মতামত জানানঃ