বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য ও তার বিদেশযাত্রা নিয়ে যেমন গভীর উদ্বেগ, তেমনি রয়েছে বহুস্তরীয় আলোচনার ঝড়। দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন, দীর্ঘদিন ধরেই যার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিতর্ক ও উৎকণ্ঠা চলছিল, তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়ার প্রস্তুতি গত কয়েক দিনে নতুন মোড় নিয়েছে। কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে লন্ডনে নেওয়ার কথা থাকলেও সেই ফ্লাইটের সময় পিছিয়ে যাওয়ায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তেও বিলম্ব এসেছে। একই সঙ্গে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে শুরু করে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের প্রতিটি বক্তব্যই আরও স্পষ্ট করেছে যে রাজনৈতিক ও মানবিক—উভয় দিক থেকেই পরিস্থিতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।
বিএনপির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে শুক্রবার সকালে জানানো হয় যে কারিগরি ত্রুটির কারণে কাতার থেকে পাঠানো ওই এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নির্ধারিত সময়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারছে না। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সবকিছু ঠিক থাকলে অ্যাম্বুলেন্সটি শনিবার ঢাকায় আসার কথা। তবে আসল সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে মেডিকেল বোর্ডের ওপর—তারা যদি মনে করেন যে খালেদা জিয়া যাত্রার জন্য উপযুক্ত, তাহলে রবিবার তিনি লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দিতে পারেন। এই ঘোষণার আগে বিএনপির চিকিৎসক ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানিয়েছিলেন যে শুক্রবার রাতে বা ভোরে যাত্রা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায় রাতেই, যখন দলের প্রেস উইং জানায়—ফ্লাইটে কারিগরি সমস্যার কারণে যাত্রা স্থগিত করতে হচ্ছে।
এদিকে নতুন আরেকটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ জোবাইদা রহমানের বাংলাদেশে আগমন। শুক্রবার সকাল ১১টায় ঢাকায় পৌঁছানো জোবাইদা রহমানকে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে তিনি খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিতে এসেছেন। দীর্ঘদিন ধরেই লন্ডনে অবস্থান করা তিনি এবার সরাসরি দায়িত্ব নিতে দেশে এসেছেন—যা বিএনপির ভেতরে ও বাইরে নানা বার্তা বহন করছে। লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের স্ত্রী হিসেবে তিনি পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসাবিষয়ক সিদ্ধান্তে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারেন বলেও দলের নেতারা মন্তব্য করছেন।
ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে এরপর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। হাসপাতালের বাইরের রাস্তায় পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতি এবং অভ্যন্তরে এসএসএফের মোতায়েন—সবই জানান দিচ্ছিল যে ঘটনাটির গুরুত্ব কেবল চিকিৎসা-সংক্রান্ত নয়, রাজনৈতিকভাবেও তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সকাল থেকেই সেখানে গণমাধ্যমের ভিড় বাড়তে থাকে; সাধারণ মানুষও জড়ো হন খবর জানতে। গত ২৩শে নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে প্রতিটি আপডেটই দেশের রাজনীতিকে নাড়া দিয়ে চলেছে। প্রথমে বলা হয়েছিল ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রে গুরুতর সংক্রমণের কারণে তিনি সংকটাপন্ন, পরে জানানো হয় তার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলেও চিকিৎসায় কিছু সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
এবারের অসুস্থতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বহু বছর ধরেই খালেদা জিয়া নানা জটিল রোগে ভুগছেন—লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা, ফুসফুস সমস্যা, চোখের সমস্যা—সব মিলিয়ে তার চিকিৎসা ক্রমেই জটিল হচ্ছে। ২০২১ সালে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। ২০২৪ সালে তার হৃদপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয়। একই বছর বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে তার লিভারের জন্য পোর্টো সিস্টেমেটিক অ্যানেসটোমেসি করা হয়েছিল। আরও আগে তার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়েছিল, যার একটি রিং দিয়ে খুলে দেওয়া হয়। প্রতিটি চিকিৎসা-ঘটনা যেন তার রাজনৈতিক অবস্থানকেও পরিবর্তিত করে দিয়েছে—বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক নেতাদের শারীরিক অবস্থা সবসময়ই দলীয় কৌশলে প্রভাব ফেলে।
২০১৮ সালের দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজা হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর তার জীবনযাত্রা আমূল বদলে যায়। জেল, হাসপাতালে চিকিৎসা এবং পরে সরকারের বিশেষ নির্বাহী আদেশে তার মুক্তি—সব মিলিয়ে তার রাজনৈতিক ভূমিকা সীমিত হয়ে আসে। ২০২৪ সালের অগাস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতির আদেশে তিনি সম্পূর্ণভাবে দণ্ডমুক্ত হন। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিনি লন্ডনে চিকিৎসার জন্য যান এবং কিছুদিন পর ফিরে আসেন। কিন্তু তারপরেও তার শারীরিক অবস্থা পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। সাম্প্রতিক সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানেও অংশ নেওয়ার পর তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়, যা শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে।
এমন পরিস্থিতিতে লন্ডনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সামনে এলেও এটি ছিল খুবই জটিল প্রক্রিয়া। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে আসছিলেন যে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে সরকারি অনুমতির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন, এবং দলটি বলছে যে চিকিৎসার জায়গায় আর কোনো বাধা নেই—কেবল চিকিৎসকদের পরামর্শই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করবে। তবে তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রসঙ্গ আবারও আলোচনায় আসে, যদিও তিনি সামাজিক মাধ্যমে জানান যে এই সিদ্ধান্ত তার হাতে নেই। এ কথাটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, অনেকেই মনে করছেন যে পরিবার ও দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণও এ ধরনের সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখছে।
খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা পিছিয়ে যাওয়ায় জনমনে যে নতুন প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে তা হলো—তার শারীরিক অবস্থা কি এই অপেক্ষার চাপ সামলাতে পারবে? এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের কারিগরি ত্রুটি নিছক একটি বিলম্ব তৈরি করলেও রোগীর অবস্থার ওপর এর প্রভাব কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। একই সঙ্গে, লন্ডনে গেলে চিকিৎসার মান উন্নত হবে তা যেমন নিশ্চিত, তেমনি দেশে তার অনুপস্থিতিতে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল কী হবে—সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়া দেশের রাজনীতিতে কেবল একজন নেতা নন, বরং তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ক্ষমতা, প্রতিরোধ ও প্রতীক—সব কিছুতেই একটি বড় নাম। তার অনুপস্থিতি রাজনৈতিক নেতৃত্য কাঠামোকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
তার শরীরের প্রতিটি চিকিৎসাগত জটিলতা যেমন মানবিক বাস্তবতায় উদ্বেগের সৃষ্টি করে, তেমনই তার অবস্থার রাজনৈতিক প্রতিফলনও বিস্তৃত। বিএনপির ভেতরে অনেকেই মনে করেন যে তার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্যকে প্রভাবিত করতে পারে। আরেকদিকে, সাধারণ মানুষ—যারা তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখেন—তাদের আবেগও যুক্ত হয়েছে এই দূরত্বে। হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড়, সংবাদমাধ্যমের অবিরাম আপডেট অনুসন্ধান—সব মিলিয়ে স্পষ্ট যে তার স্বাস্থ্য কেবল ব্যক্তিগত বিষয় নয়; এটি একটি জাতীয় উদ্বেগের অংশ।
ধীরে ধীরে সব কিছু নির্ভর করছে এই প্রশ্নে—মেডিকেল বোর্ড কি মনে করছে তিনি দীর্ঘ বিমানযাত্রার মতো চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত? যদি প্রস্তুত হন, তাহলে লন্ডনে পৌঁছানোর পর চিকিৎসা কতটা দ্রুত তার অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারবে? আর যদি না পারেন, তাহলে দেশে তার চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা কতটা অতিক্রম করা সম্ভব? প্রতিটি প্রশ্নই এখন সমান গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে বলা যায়, খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রা কেবল একটি চিকিৎসামূলক যাত্রা নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি প্রতীকী অধ্যায়ও। তার স্বাস্থ্য যেমন তাকে দীর্ঘদিন ধরে শারীরিকভাবে দুর্বল করে তুলেছে, তেমনই দেশের রাজনৈতিক আঙ্গিনাকেও প্রভাবিত করছে তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স বিলম্বিত হওয়ায় তার যাত্রা সাময়িকভাবে পিছিয়ে গেলেও দেশের রাজনৈতিক আলোচনা সেই জায়গায় থেমে নেই। হাসপাতালে শোয়ানো খালেদা জিয়ার প্রতিটি নিঃশ্বাস, তার প্রতিটি রিপোর্ট, প্রতিটি আপডেট—সবই যেন বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে বাংলাদেশে রাজনীতি, মানবিকতা এবং চিকিৎসা—এই তিনটি ক্ষেত্রই একে অপরের সঙ্গে জটিলভাবে জড়িত। এখানে একজন নেতার সুস্থতা একটি ব্যক্তিগত বিষয় হলেও তার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে পুরো জাতির অনুভূতি ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিকে।
আপনার মতামত জানানঃ