কর্ণফুলী নদীর মোহনার অদূরে, গুপ্তবাঁক এলাকায় নির্মিতব্য লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালকে ঘিরে দেশের বন্দর অর্থনীতি, নীতিনির্ধারণ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা ক্রমেই নতুন মাত্রা পাচ্ছে। সরকারি প্রচারণা টার্মিনালটিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কেন্দ্র বলে তুলে ধরলেও প্রকাশিত তথ্য–বিশেষ করে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টে থাকা গোপন স্ল্যাব, মেয়াদ, রাজস্ব কাঠামো এবং অপারেটরের প্রভাব–এগুলোর বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুক্তিতে এমন অনেক সুবিধা লুকিয়ে আছে যা একতরফাভাবে বিদেশী অপারেটরের জন্য লাভজনক। ফলে লালদিয়া টার্মিনাল শুরু হওয়ার আগেই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের বন্দর পরিচালনার ইতিহাসে এটি কি একটি ‘লো-রিস্ক, হাই-রিটার্ন’ মডেলের মাধ্যমে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের জন্য অতিরিক্ত সুবিধা নিশ্চিত করেছে? এর বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) কি আদৌ শক্ত অবস্থানে ছিল?
বন্দর সংশ্লিষ্টদের মতে, লালদিয়ার অবস্থানগত সুবিধা অসাধারণ। কর্ণফুলীর মুখে এমন এক জায়গায় টার্মিনালটি নির্মাণ হবে, যেখানে জাহাজ প্রবেশ করবে সহজেই এবং দ্রুত কনটেইনার হ্যান্ডলিংও সম্ভব হবে। এ সুবিধা লালদিয়াকে চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে ব্যস্ত টার্মিনালে পরিণত করতে পারে। সরকার বলছে, বছরে ১০ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা থাকবে টার্মিনালে; তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাস্তবে এর পরিমাণ আরো বেশি হবে। কারণ অপারেটর হিসেবে থাকছে বিশ্ববিখ্যাত ডেনমার্কভিত্তিক এপি-মোলার গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস, যারা আন্তর্জাতিক শিপিং ব্যবসায় বহু বছর ধরে শক্তিশালী অবস্থানে। তাদের নিজস্ব শিপিং লাইন মায়ের্সক বিশ্বের অন্যতম বড় কোম্পানি, এবং চট্টগ্রামে ইতোমধ্যেই তাদের বাজার নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি। ফলে অপারেশন শুরু হলে লালদিয়ার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের বড় অংশই চলে যেতে পারে তাদের হাতে।
চুক্তির সবচেয়ে আলোচিত অংশ হলো তিনটি রাজস্ব স্ল্যাব—যার তৃতীয়টি সরকারি প্রচারণায় একবারও উল্লেখ করা হয়নি। প্রথম স্ল্যাবে বছরে আট লাখ টিইইউ পর্যন্ত বন্দর পাবে ২১ ডলার, দ্বিতীয় স্ল্যাবে আট থেকে নয় লাখ টিইইউ পর্যন্ত ২২ ডলার। কিন্তু নথিতে তৃতীয় স্ল্যাবের তথ্য অনুযায়ী, বছরে নয় লাখ টিইইউ ছাড়ালেই চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব নেমে আসবে টিইইউপ্রতি মাত্র ১০ ডলারে। বন্দর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লালদিয়ার সুবিধাজনক অবস্থান, জাহাজ আগমনের সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি এবং এপিএম টার্মিনালসের নিজস্ব বাজার সক্ষমতা বিবেচনায় তৃতীয় স্ল্যাব কার্যকর হওয়া খুবই সম্ভব। সেক্ষেত্রে অপারেটর লাভবান হলেও চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব কমে যাবে বড় আকারে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে চবকের আর্থিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শিল্প ও অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এপিএম টার্মিনালসের পরোক্ষ সুবিধা আরো বহুমাত্রিক। তাদের যদি সরাসরি ইউরোপ বা আমেরিকার সঙ্গে কনটেইনার জাহাজসেবা চালুর সুযোগ তৈরি হয়, তাহলে লালদিয়া হয়ে তাদের আয় বাড়বে বহু গুণ। তাদের নিজস্ব জাহাজ টার্মিনালে অগ্রাধিকার পেলে জটিলতা কমবে, অলস বসে থাকার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। দিনে ১০-১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত যে ব্যয় এড়ানো সম্ভব হবে, সেটিও তাদের জন্য বড় আর্থিক সুবিধা। এই সব সুবিধা মিলিয়ে লালদিয়াকে তাদের ব্যবসায়িক ভবিষ্যতের জন্য একটি নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চুক্তির মেয়াদ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সরকারি প্রচারনায় বলা হয়েছিল, ৩০ বছর অপারেশন এবং শর্ত পূরণ হলে বাড়তি ১৫ বছর মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। তবে নথিতে দেখা যাচ্ছে, চুক্তির মোট মেয়াদ ৪৮ বছর—নির্মাণ তিন বছর, পরিচালনা ৩০ বছর এবং ‘বাধ্যতামূলক’ ১৫ বছরের বর্ধিত মেয়াদ। এখানে “ফিফটিন ইয়ার্স মাস্ট বি এক্সটেন্ডেবল” শব্দটি বিশেষজ্ঞদের মতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সাধারণত এ ধরনের কনসেশন চুক্তির মেয়াদ বিশ্বমান অনুযায়ী ২০–২৫ বছর হয়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের (পিসিটি) ক্ষেত্রে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালস ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল মোট ২২ বছরের, যেখানে দুটি পক্ষই সমানভাবে সুবিধা পায়। লালদিয়ার ক্ষেত্রে সেই নেগোসিয়েশনের শক্তি কোথায় হারিয়ে গেল—সে প্রশ্ন উঠছে।
পিসিটির ক্ষেত্রে চবক চুক্তির দিনই পেয়েছিল ২০ মিলিয়ন ডলার আপফ্রন্ট ফি—যা সঙ্গে সঙ্গে বন্দরের তহবিলে যোগ হয় এবং পরে ফিক্সড ডিপোজিটে রেখে সুদ আকারে আর্থিক সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ৪৯ একর গ্রিনফিল্ডে লালদিয়ার চুক্তিতে আপফ্রন্ট ফি একই হারে নির্ধারণ হলেও এখনো বন্দর সে অর্থ পায়নি। চবক বলছে, চুক্তি কার্যকর হতে ৯০ দিন লাগবে এবং কার্যকর হওয়ার পর ৫০ শতাংশ, আর বাকি ৫০ শতাংশ পাবে অপারেশন শুরুর পর। এত বড় বিনিয়োগে আপফ্রন্ট ফি বিলম্বিত হওয়ার কারণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।
চুক্তির ব্যাক-টু-ব্যাক কাঠামো নিয়ে আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো স্থানীয় এজেন্ট নির্বাচন। আন্তর্জাতিক অপারেটররা সাধারণত স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করলেও বাংলাদেশে তাদের দায়দেনা, ক্ষতিপূরণ বা যেকোনো ঝুঁকির চূড়ান্ত দায়িত্ব মূল প্রতিষ্ঠানই বহন করেছে—যেমন আরএসজিটিআই বা মেডলগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। কিন্তু এপিএম টার্মিনালস স্থানীয় সহযোগী হিসেবে বেছে নিয়েছে কিউএনএস লিমিটেডকে, যার স্বত্বাধিকারী নুরুল কাইয়ুম খান ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এতে যৌথ কাঠামোয় দায়দায়িত্ব বণ্টন, আইনি জটিলতা বা ভবিষ্যৎ ঝুঁকি কে বহন করবে—তা এখনো পরিষ্কার নয়।
নীতিগতভাবে চুক্তিতে স্বচ্ছতার ঘাটতির কথা বলছেন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর মতে, শর্তগুলো গোপন রাখার প্রবণতা প্রশ্ন তৈরি করে—জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হয়েছে কি না, কত সময় পরে টার্মিনাল দেশের নিয়ন্ত্রণে আসবে, কী আর্থিক কাঠামো অনুসরণ করা হয়েছে—এসব বিষয় শুরু থেকেই পরিষ্কার করা প্রয়োজন ছিল। তিনি মনে করেন, নেগোসিয়েশন পর্যায়ে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে চুক্তির দুর্বলতা কম হতে পারত। বিশেষ করে ৪৮ বছরের দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ—সে প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির মতে, এসকল চুক্তি করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল, সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে যথাযথ আলোচনা করা হয়নি। এতে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, এবং জাতীয় সম্পদ–বন্দর ব্যবস্থার মতো কৌশলগত খাতে গোপনীয়তার প্রয়োগ অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা ভালো অবস্থানে আছে। চবকের সচিব মো. ওমর ফারুকের মতে, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ইউরোপ থেকে আসা সবচেয়ে বড় প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ, যেখানে রাষ্ট্রকে কোনো বিনিয়োগই করতে হবে না। টার্মিনাল চালু হলে জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম কমবে, বড় জাহাজ আসবে, সরাসরি ইউরোপে যাতায়াতের সুযোগ তৈরি হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের লজিস্টিক্স খাতকে উপকৃত করবে।
তবে সব ইতিবাচক সম্ভাবনার পরও এক প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠছে—চুক্তির কাঠামো কি একটি সমান ‘উইন-উইন’ মডেলে তৈরি? বন্দর অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের মতে, পিসিটি চুক্তিতে চবক যে দৃঢ়তা দেখিয়েছিল, লালদিয়ায় তা দেখা যায়নি। এখানে অপারেটরের আয় বাড়ার ব্যাপক সুযোগ থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব নির্দিষ্ট সীমার পর কমতে থাকবে। দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থেও চবক অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থানে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে লালদিয়া টার্মিনাল চুক্তি শুধু একটি অবকাঠামো প্রকল্প নয়; এটি বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর অর্থনীতির ভবিষ্যৎ, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, বাজার নিয়ন্ত্রণ, বিদেশী বিনিয়োগের শর্ত এবং নীতিনির্ধারণের স্বচ্ছতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে। উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের স্বার্থে বিদেশী বিনিয়োগ জরুরি; কিন্তু সেই বিনিয়োগের শর্ত কতটা ন্যায্য, ভবিষ্যৎ বাজার কে নিয়ন্ত্রণ করবে, রাজস্ব কাঠামো কেমন হবে, এবং জাতীয় সম্পদের ওপর দীর্ঘমেয়াদে কতটা প্রভাব পড়বে—এসব প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে লালদিয়া টার্মিনাল বাংলাদেশের জন্য সত্যিকারের সুবিধা বয়ে আনবে কি না। চুক্তির এই সূক্ষ্ম দিকগুলো স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এ বিতর্ক থেমে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
আপনার মতামত জানানঃ