বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক বরাবরই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও কূটনীতির একটি সংবেদনশীল অধ্যায়। ভৌগোলিক নৈকট্য, অভিন্ন ইতিহাস, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ এবং নিরাপত্তা বাস্তবতার কারণে এই সম্পর্ক কখনো সহযোগিতার, কখনো সন্দেহ ও টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও আসন্ন জাতীয় নির্বাচন—এই সম্পর্ককে নতুন করে মূল্যায়নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) সর্বশেষ বিশ্লেষণ বলছে, এই মুহূর্তটি দুই দেশের জন্য একই সঙ্গে ঝুঁকি ও সুযোগ—যেখানে ভুল সিদ্ধান্ত সম্পর্ককে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দিতে পারে, আবার সঠিক পদক্ষেপ দীর্ঘদিনের অস্থিরতা কাটিয়ে স্থিতিশীলতার পথও খুলে দিতে পারে।
আইসিজির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রাখাকে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে প্রায় সমার্থকভাবে দেখে এসেছে। নয়াদিল্লির এই দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে ভারতের স্বার্থ রক্ষার কৌশল হিসেবে বিবেচিত হলেও, অন্যদিকে এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের প্রকাশ্য ও অকুণ্ঠ সমর্থন বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকে দিয়েছে।
অনেকের কাছে এই সম্পর্ক এমন এক ধারণা তৈরি করেছে যে, ভারত একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তিকে টিকিয়ে রাখার বিনিময়ে একতরফাভাবে রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করছে। এই মনস্তাত্ত্বিক ক্ষোভই শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানের আবহে শেখ হাসিনার পতনের অন্যতম প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ভারতের জন্য ছিল বড় ধাক্কা।
টানা ১৫ বছর ধরে হাসিনার সরকার ছিল নয়াদিল্লির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আঞ্চলিক মিত্র। ভারতের সমর্থন আওয়ামী লীগকে পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা উল্টো ফল দিতে শুরু করে। বাংলাদেশে সরকার যত বেশি অজনপ্রিয় হয়েছে, ভারত তত বেশি জনগণের চোখে সন্দেহের প্রতীক হয়ে উঠেছে। হাসিনা দেশ ছাড়ার পর তাঁকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত সেই তিক্ততাকে আরও গভীর করে তোলে।
আইসিজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনা-পরবর্তী সময়ে ঢাকা ও নয়াদিল্লির সম্পর্ক দ্রুত অবনতির দিকে যায়। উভয় পক্ষই একে অপরের উদ্দেশে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে শুরু করে, সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ে, বাণিজ্য ও যোগাযোগে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বাংলাদেশিদের ভিসা স্থগিত, আন্তসীমান্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ এবং নিরাপত্তার অজুহাতে কূটনৈতিক শীতলতা—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও সম্পর্কের অবনতি সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। ভারতের ভেতরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান এবং বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ—এই দুই প্রবণতা পারস্পরিক অবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে আইসিজি মনে করছে, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লি হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না, তবে ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বাস্তব সুযোগ এনে দিয়েছে। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা এখন মূলত সেই নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারায় বিএনপিকে সম্ভাব্য বিজয়ী দল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সহজ ছিল না, বরং পারস্পরিক সন্দেহ ও দূরত্বই বেশি ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য বিএনপিই এখন নয়াদিল্লির কাছে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।
তবে আইসিজি সতর্ক করে বলেছে, এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে উভয় পক্ষকেই পুরোনো ভুল থেকে সরে আসতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি পুরোনো কৌশল হলো নির্বাচনের সময় ভারতবিরোধী মনোভাবকে ভোট আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। এই প্রবণতা শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ক্ষতি করে না, বরং ভারতের নীতিনির্ধারকদের সেই ধারণাকেই শক্তিশালী করে যে, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের বক্তব্য ও কৌশল পরিহার করা এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সময়ের দাবি।
অন্যদিকে ভারতের প্রতিও আইসিজির বার্তা স্পষ্ট। শুধু একটি রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভরতা ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সব পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশল গ্রহণ করা উচিত নয়াদিল্লির। এতে শুধু সরকার-সরকার সম্পর্ক নয়, জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগও শক্তিশালী হবে। দীর্ঘমেয়াদে এই কৌশলই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঝাঁকুনি থেকে রক্ষা করতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এই সম্পর্ককে জটিল করে তুলছে। বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি এবং অবৈধ অভিবাসন নিয়ে অতিমাত্রায় নিরাপত্তাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশিদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়াচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা সহিংস বিক্ষোভ ভারতের ভেতরে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। এই পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার চক্র থেকে বের হতে না পারলে সম্পর্ক দীর্ঘদিনের জন্য নিম্নমুখী হয়ে পড়তে পারে।
আইসিজির বিশ্লেষণে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা কম হলেও এই টানাপোড়েন ‘নিম্নমাত্রার অস্থিতিশীলতা’ তৈরি করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে সহিংস বিক্ষোভ, সাম্প্রদায়িক হামলা, সীমান্ত হত্যা, বিদ্রোহী তৎপরতা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার স্থবিরতা। এই পরিস্থিতি কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়। বরং এটি উভয় দেশের উন্নয়ন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
প্রতিবেদনে অতীতের ‘সোনালি অধ্যায়’-এর কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নির্বাচনী বিজয়ের পর বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক এক নতুন গতি পেয়েছিল। স্থল ও সমুদ্রসীমা সমস্যার সমাধান, শুল্ক হ্রাস, ট্রানশিপমেন্ট চুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন—এসব উদ্যোগ দুই দেশের অর্থনৈতিক সংহতিকে শক্তিশালী করেছিল। একই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি পর্যটক ও রোগী ভারতে যাতায়াত শুরু করেন। কিন্তু সেই সময়েই জনগণের মধ্যে এই ধারণাও গড়ে ওঠে যে, এই ঘনিষ্ঠতার বিনিময়ে বাংলাদেশ একতরফাভাবে ছাড় দিচ্ছে। এই দ্বন্দ্বময় অভিজ্ঞতাই আজকের অনাস্থার পটভূমি তৈরি করেছে।
আইসিজি মনে করে, সামনে এগোনোর পথ একটাই—বাস্তববাদী ও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি। ভারতের উচিত হবে নিজেদের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংবেদনশীলতা বিবেচনায় রাখা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, যোগাযোগ পুনরায় চালু করা এবং নতুন সরকারের সঙ্গে আগ্রহী হয়ে আলোচনায় বসা হতে পারে আস্থা পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ। অন্যদিকে বাংলাদেশের সম্ভাব্য নতুন সরকারের উচিত হবে ভারতের ইতিবাচক উদ্যোগে সাড়া দেওয়া, সীমান্ত নিরাপত্তা, বিদ্রোহ ও চরমপন্থা দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এবং আন্তসীমান্ত অপরাধ ও অবৈধ অভিবাসন রোধে সহযোগিতা বাড়ানো।
সবশেষে আইসিজি যে বার্তাটি সবচেয়ে জোর দিয়ে দিয়েছে, তা হলো—বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ককে আর কোনো একক রাজনৈতিক দলের ভাগ্যের সঙ্গে বেঁধে রাখা যাবে না। জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতেই এই সম্পর্ককে টেকসই করতে হবে। নইলে প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে সংকটে পড়বে, যার মূল্য দিতে হবে উভয় দেশের সাধারণ মানুষকেই।
আপনার মতামত জানানঃ