রাজধানীর কড়াইল বস্তি সাধারণত শহরের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বসতি এলাকাগুলোর একটি হিসেবেই পরিচিত। এই এলাকায় মানুষের বসবাসের ধরন, ঘরগুলোর নির্মাণসামগ্রী এবং অত্যন্ত সঙ্কুচিত পরিবেশের কারণে আগুন লাগলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। শুক্রবার দিনগত রাত ১২টা ৪৪ মিনিটে যখন রান্নাঘরের চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়, তখন পুরো বস্তিতে মানুষ ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল অথবা অনেকেই ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। এমন অবস্থায় আগুনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম নিশ্চিত করেন যে আগুন লাগার উৎস ছিল একটি রান্নাঘরের চুলা। সাধারণত বস্তি এলাকাগুলোতে তরল গ্যাসের চুলা, খোলা আগুন, অরক্ষিত সিলিন্ডার কিংবা বৈদ্যুতিক লাইনের শর্ট সার্কিট—সব মিলিয়েই নিয়মিত আগুন লাগার ঝুঁকি থাকে। ফলে এমন দুর্ঘটনা কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু প্রতিবারই ক্ষতি হয় ব্যাপক।
রাত ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ১০টি ইউনিটের ফায়ার ফাইটাররা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। বাঁচাতে পারেননি ৬১টি ঘর—যেগুলোতে অর্ধশতাধিক পরিবার তাদের সব কিছু হারিয়ে ফেলেছে। আগুনে কোনো প্রাণহানি না হওয়াটাই ছিল বড় সান্ত্বনা। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টাকা বলে জানানো হলেও বস্তিবাসীর জন্য বাস্তবিক ক্ষতি এর চেয়েও বেশি। কারণ তাদের প্রতিটি জিনিস—পোশাক, রান্নার সামগ্রী, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, শিশুদের বই, এমনকি জীবনের সঞ্চয় রাখা ছিল ওই ঘরগুলোতেই। এসব ক্ষতির আর্থিক হিসাব কখনো পুরোপুরি করা যায় না। আবার অনেক পরিবার যে অস্থায়ী ঘরই বানিয়ে নেন না কেন, ভবিষ্যৎ ভয়, দুশ্চিন্তা এবং অনিশ্চয়তা তাদের জীবনে আরেক ধরনের আগুন জ্বালিয়ে রাখে।
এদিকে একই দিনে রাজধানীর অন্যপ্রান্তেও আগুনের ভয়াবহতা দেখা যায়। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে খিলগাঁওয়ের তালতলায় একটি স’মিলে আগুন লেগে যায়। স’মিল মানেই কাঠ, কাঠের গুঁড়া, কেমিক্যাল, বার্নিশ—সব মিলিয়ে অত্যন্ত দাহ্য পরিবেশ। ফলে স’মিলের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাশের একটি গ্যারেজেও। গ্যারেজে থাকা বিভিন্ন গাড়িতে আগুন ধরে এবং সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটে। এসব বিস্ফোরণ শুধু আগুনকেই ভয়াবহ করে তোলে না, আশপাশের মানুষের মধ্যে আতঙ্কও বাড়ায়। ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার জানান, রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। অর্থাৎ দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আগুন তার ভয়ংকরতা নিয়ে জ্বলতে থাকে। তিনি আরও জানান, আগুন লাগার পর প্রথমে দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গেলেও দ্রুত পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় ইউনিট সংখ্যা বাড়িয়ে ৯-এ নেওয়া হয়। এতে বোঝা যায় আগুনের তীব্রতা এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে।
আগুনে অন্তত ২০টি দোকান ও দুটি স’মিল পুড়ে গেছে। এই ক্ষতি শুধু ব্যবসায়িক ক্ষতি নয়; বহু মানুষের জীবিকা সরাসরি এই দোকান ও স’মিলগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল। মালিক, কর্মচারী, শ্রমিক—সবার জীবনেই আগুন যেন নতুন করে অনিশ্চয়তা এনে দিয়েছে। এক রাতে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেলে নতুন করে দাঁড়াতে যে অর্থ, সাহস এবং সময় লাগে, তা অনেকের জন্যই অতিক্রম করা কঠিন। আগুনে হতাহতের কোনো ঘটনা না থাকলেও অর্থনৈতিক আঘাত দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ হতে পারে, যা আমরা প্রায়ই বড় অগ্নিকাণ্ডের পর দেখি না, কিন্তু ভুক্তভোগীরা সারাজীবন বয়ে বেড়ান।
এই দুই অগ্নিকাণ্ডের সময়গত মিল থাকায় অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন—এগুলো কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি ‘আগুন সন্ত্রাস’? প্রশ্নটি আসে মূলত সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘন হলে অতীতে বাসে আগুন, বাজারে আগুন কিংবা বস্তিতে আগুন লাগার মতো ঘটনাগুলোকে অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সন্দেহ করা হয়েছে। কিন্তু এই দুই ঘটনার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখনই এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সঠিক নয়।
কারণ কড়াইল বস্তিতে আগুনের উৎস ছিল রান্নাঘরের চুলা—যা বস্তিতে প্রায় প্রতিদিনই ঝুঁকি তৈরি করে। খুব সাধারণ, খুব চেনা একটি কারণ। খিলগাঁওয়ের স’মিলেও আগুন লাগার কারণ প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি; সেখানে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, অসতর্কতা বা দাহ্য পদার্থের অসাবধানী ব্যবহার—সবই হতে পারে কারণ। ফায়ার সার্ভিস এখনো আগুনকে ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেনি। রাজনৈতিক অগ্নিসন্ত্রাস সাধারণত জনসমাগমে, পরিবহনে, বা রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের ওপর চাপ তৈরি করার জায়গায় ঘটে। কিন্তু এখানে দুটি ঘটনাই হয়েছে এমন জায়গায়, যেখানে দুর্ঘটনাজনিত আগুন লাগার সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবে অনেক বেশি।
তারপরও প্রশ্ন উঠবে—কেন একই দিনে দুই প্রান্তে এত বড় আগুন? এটি কি কাকতালীয়? বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যায়, শীতকাল ও শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগার সংখ্যা সাধারণত বেড়ে যায়। কারণ তখন বাতাসের আর্দ্রতা কমে, আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়টায় গ্যাস লিকেজ, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ—এসব ঘটনাও বেড়ে যায়। একই দিনে দুটি অগ্নিকাণ্ড তাই বড় অস্বাভাবিক নয়। তবে, প্রত্যেকটি ঘটনাই গভীরভাবে তদন্ত করা উচিত—কারণ আগুনের সূত্রপাত নির্দোষ ভুল থেকেও হতে পারে, আবার অসতর্কতা, অবহেলা বা পরিকল্পিত নাশকতা থেকেও ঘটতে পারে।
অগ্নিকাণ্ডের রাজনীতি তাই খুব সতর্কভাবে দেখা প্রয়োজন। বস্তি এলাকায় আগুন লাগলেই অনেক সময় গুজব ছড়ায় যে এটি জমি দখলের চেষ্টা কিংবা রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের অপচেষ্টা। আবার স’মিল বা ব্যবসায়িক এলাকায় আগুন লাগলে বলা হয় প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের নাশকতা। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া এসব অনুমান কেবল জনমনে ভয় বাড়ায়, সমাধান দেয় না। বরং প্রয়োজন হলো সঠিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের কারণ শনাক্ত করা, বস্তিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা, স’মিল বা শিল্প এলাকাগুলোতে নিয়ম মানা নিশ্চিত করা এবং দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া।
রাজধানীর মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে অগ্নিকাণ্ড প্রতিদিনের ভয়ের নাম। মানুষের জীবনযাত্রা, বাড়ি নির্মাণের ধরন, বৈদ্যুতিক লাইন এবং গ্যাস ব্যবহারের অবস্থা—সবকিছু মিলিয়েই আগুন যেন অদৃশ্যভাবে প্রতিদিন মানুষের পাশে হাঁটে। অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতি শুধু আগুনে পুড়ে যাওয়া নয়; এটি মানুষের মনে যে অনিরাপত্তার আগুন জ্বালায়, তা দীর্ঘস্থায়ী। বস্তিবাসী প্রতিটি রাত কাটায় এই ভয়ে যে কোনোদিন হঠাৎ আগুন এসে সব ছাই করে দিতে পারে। স’মিলে কাজ করা শ্রমিকরা জানে, অসতর্কতার এক ঝলক পুরো জীবনের সঞ্চয় কেড়ে নিতে পারে। এই ভয়ই আসলে অগ্নিকাণ্ডের সবচেয়ে বড় দুঃসহ পরিণতি।
তাই প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হওয়া উচিত—মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, পুনর্বাসন করা এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া। শুধু অগ্নিকাণ্ডের খবর জানানো বা ‘কারণ জানা যায়নি’ বলে দায়িত্ব এড়ানো নয়, বরং বস্তিতে নিরাপদ রান্নাঘর তৈরি, সিলিন্ডার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ, পুরনো বৈদ্যুতিক লাইনের সংস্কার, স’মিলসহ দাহ্য কারখানাগুলোর উপর কঠোর নজরদারি—এসব জরুরি। শহরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতেই নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি সর্বোচ্চ হওয়া উচিত, কিন্তু বাস্তবে হয় তার উল্টো।
এই দুই অগ্নিকাণ্ডকে রাজনৈতিক ‘আগুন সন্ত্রাস’ বলা যায় কি না—তা নির্ভর করবে তদন্তের ফলাফলের উপর। আপাতভাবে এগুলো দুর্ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। তবে আগুন এখন আর শুধু শারীরিক ঘটনা নয়; এটি মানুষের জীবনে ভয়, দারিদ্র্য এবং বাস্তুচ্যুতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। রাজধানীর প্রতিটি বড় অগ্নিকাণ্ড আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শহর যত বড়ই হোক, নিরাপত্তা যদি ভঙ্গুর হয়, তাহলে পুরো শহরটাই এক বিশাল অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হতে পারে যে কোনোদিন।
সেই ভয়কে জয় করতে হলে দরকার পরিকল্পনা, দায়িত্ববোধ, সঠিক ব্যবহার এবং কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি—নয়তো আগুন বারবার ফিরে আসবে, ঘর পুড়বে, জীবন ভাঙবে, আর আমরা কেবল পরদিন সকালে খবরের কাগজে নতুন শিরোনাম পড়তে থাকব।
আপনার মতামত জানানঃ